মিরাজ মোহাইমেন

১.
বন্ধুর মারফতে মৃত্যুর বার্তা জারিত হয় আমাদের মাঝে, তদুপরি শোকগ্রস্ত; কবির প্রস্থান বিচলিত করে কবি মাত্রই। সাথে পাঠককুল বেদনায় জর্জরিত হন তো বটেই! বাস্তবত বহুকাল যে কবি বেঁচে থেকে বাংলা কবিতাকে শাসন করে গেলেন, সৃজননেশা যাকে এতদূর নিয়ে এল তাঁর মৃত্যু জাতিকে অবশ্যই ব্যথিত করেছে। সেই পরম্পরায় এ লেখার পয়লা-ভাগে পাঠকের সামনে আমরা উপস্থিত করছি পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের বার্তাটি। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকাকে শোকবার্তায় জানাচ্ছেন, ফজল শাহাবুদ্দীন আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন। তার মৃত্যুতে এতই দুঃখ পেয়েছি, যা একমাত্র আমি ছাড়া আর কাউকে ঠিকমতো বোঝানো যাবে না।

ফজল আমাদের সমসাময়িক কবি বন্ধুদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথমদিকে তার কাব্য রচনার একটা দারুণ আগ্রহ এবং গতিময়তা ছিল। তিনি হৃদয়ে প্রকৃত কবিত্বের এবং কাব্য সৃজনে আবেগে উদ্ভাসিত থাকতেন। তবে তার ব্যক্তিজীবনের নানা বাস্তবতা তার বন্ধুদের মতো তাকে কাব্য রচনায় ক্রমাগত তাড়না করে ফিরতে পারেনি। তার কবিতা সংখ্যা একেবারে কম নয়। 'তৃষ্ণা অগ্নিতে একা'সহ আরও অন্যান্য বই তার কবিত্ব শক্তির পরিচয় বহন করেছে। তিনি নিজেকে পঞ্চাশ দশকের অন্যতম কবি হিসেবে সবার কাছে সুপরিচিত করে তুলতে পেরেছিলেন।

আমি সোনালী কাবিনের উৎসর্গপত্রে তিনজনের নাম উল্লেখ করে বলেছিলাম, আমাদের এককালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্য হিংসা অমর হোক এখানে শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরীর নাম ছিল। এটা এখন একটি ইতিহাসেই পরিণত হল। ভাবতেও আমার কাছে কেমন লাগছে। ফজল চলে গেলেন, এটা আমাদের মধ্যে যে গভীর শোকের সৃষ্টি করেছে, তা পরিমাপ করা যাবে না।

... ফজল একজন সৎ এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কবি ছিলেন। এ কথা আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি। তার মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

২.
কবি ও সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলছেন, 'ফজল ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভা। কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও একজন বন্ধুবৎসল মানুষ। বাংলাদেশের কবিতা আন্দোলনে তার সবচেয়ে বড় অবদান কবি শামসুর রাহমানকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকার অনুসরণে ঢাকা থেকে ‘কবিকণ্ঠ’ নামে একটি ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকা প্রকাশ। এই ‘কবিকণ্ঠ’ দীর্ঘকাল বাঁচেনি। কিন্তু পূর্ববাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাকে যে গতি ও জ্যোতির্ময়তা দিয়ে গেছে তার তুলনা বিরল।


সংবাদ-সাহিত্যেও ফজলের অবদান অতুলনীয়। পাকিস্তান আমলে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা-গোষ্ঠী (পরে দৈনিক বাংলা) থেকে ‘বিচিত্রা’ নামে তার সম্পাদনায় যে সাপ্তাহিক সাময়িকীটি বেরোয়, তাকে বলা চলে ঢাকায় সওগাত-পরবর্তী যুগে আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ বাহন। পত্রিকাটি বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

ফজলের সঙ্গে এক সময় আমি বড় বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কমলাপুর তখন গ্রাম। সেই গ্রামে টিনের বাড়ি ছিল ফজলদের। বর্ষাকালে নৌকায় চড়ে তাদের বাড়িতে যেতে হতো। ফজলদের বাড়িতে ছিল প্রচুর আমগাছ। এই আম তারা ঘরের মাচায় তুলে রাখতেন। আম পেকে যখন সুগন্ধ ছড়াত তখন ফজল আমাদের সেই আম খেতে আমন্ত্রণ জানাতেন। আমার মনে আছে, বহুবার আমরা- আমি, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান নৌকায় চড়ে তার বাড়িতে আম খেতে গেছি। আম খেতে খেতে সারা দিন চলেছে ‘আড্ডা’। আমের রস আর কবিতায় রস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

ফজল শাহাবুদ্দীন রাজনীতিবিমুখ কবি হলে কী হবে; তার কবিতায় অনেক সময় দেশের অবস্থা ও রাজনীতিও ছায়া পড়েছে। তবে তা কখনো প্রধান কায়া হয়ে ওঠেনি। আমার ভালো লেগেছে তার প্রেমের কবিতা। অনুক্ত ও সলজ্জ প্রেম নয়। বলিষ্ঠ, সাহসী ও সবাক প্রেম। তা ইন্দ্রিয়বিমুখ অতীন্দ্রিয় প্রেম নয়। এদিক থেকে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার ‘নিলাজ’ ভাষা তাকে প্রভাবিত করেছে মনে হয়।


বাংলা ভাগের পর ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের যে নববিবর্তন, পঞ্চাশের দশক তার সেরা ফসল ফলিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ফজল শাহাবুদ্দীন সেই ফসলেরই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, ২০১৪ সালে এসে যিনি ঝরে গেলেন। কিন্তু তার কবিতা ও কর্ম তো রয়ে গেল। বাংলাদেশের আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিদেরও উচিত, ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিকর্মের মধ্যেও তাদের আত্মানুসন্ধান করা। আত্মকেন্দ্রিকতা, বাস্তববিমুখতা আধুনিক কবিতাকে বড়-বেশী জড়িয়ে ফেলেছে। অধিকাংশ কবি যেন এক সঙ্গে একই আত্মকথা, একই ভাষায় আপ্তবাক্যের মতো ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন।'

সত্যিকার বিবেচনাসমূহের অগ্রভাগে লক্ষ্য করা যায়, ফজলের এই রূপ প্রতীতি ছিল যে, পৃথিবীর সব কবিই একা, যেমন সকল মানুষ। এ একাকিত্বই তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল শব্দরাজ্যে, দিয়েছে একাকী নির্মাণের মতো অসংখ্য কাব্য ক্যানভাস। ১৭ বছর বয়সে কাব্যযাত্রী ফজল অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের জনক। ৬০ বছরব্যাপী কাব্যজীবনে তার নিমগ্নতা তাকে এনে দেয় সমৃদ্ধ এক কাব্যজগৎ। এ জগৎ আলোহীন অন্ধকারহীন অথচ প্রবল ধ্বনিময়। তাঁর কবিতাগ্রন্থের নামগুলোও খুবই দ্যোতনাময়, যেন এক-একটি কবিতা। সান্নিধ্যের আর্তনাদ, আততায়ী সূর্যাস্ত, অন্তরীক্ষে অরণ্য, আকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর কিংবা তৃষ্ণার অগ্নিতে একার মধ্য দিয়ে যে ফজলের যাত্রা, তা এখন চূড়ান্তের পথে।

৩.
যখন ফজল বিশাল সমুদ্রের সফেনে চড়ে আমাদের চিন্তারাজ্যে হানা দিয়ে বলেন—

'অরণ্য সমুদ্র থেকে ধ্বনি ওঠে গগনে
গগনে পুষ্পিত শরীরে আমি হাত রাখি যখন তৃষ্ণায়
প্রাচীন অগ্নির মতো উৎক্ষিপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়
অযুত নক্ষত্র দেখি গলে যায় আমার চুম্বনে।'

তখন বিচলিত হয়ে স্থিত হই পরক্ষণে এই ভেবে— অযুত নক্ষত্রকে চুম্বনের শক্তি দিয়ে যিনি তরলে পরিণত করতে পারতেন— তিনি কি শুধুই কবি, শুধুই রক্ত-মাংসের শরীরের একজন? এ রকম প্রশ্নের উত্তরে হৃদ-অভ্যন্তর থেকে যে উত্তর আসে তা শুধু শ্রবণের জন্য নয়, উপলব্ধির বিষয়ও বটে। ফজল শাহাবুদ্দীন নিজেকে ভেঙ্গেছেন, ফের নিজেকে গড়েছেন পঙক্তির অনিন্দ্য সুন্দরের সন্ধানে। কবিতায় তিনি নিজেই অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন বারবার আর তিলতিল করে স্থাপন করেছেন কঠোর-কোমলে মেশানো এক সুরমা প্রাসাদ।

যার অধিশ্বর শুধু তিনি, শুধু তিনি; আর কেউ নন। কবিতা যদি উপলব্ধির বিষয় হয় তবে সেখানে ফজল নিঃসন্দেহে এক মহান কারিগর আর যদি তা শুধু শ্রবণের হয়, তাতেও তার সাবলীলতা একান্তভাবে দৃশ্যমান। সতীর্থরা যখন প্রেমেমুগ্ধ তখন তিনি নারীকে অতিক্রম করে হাত বাড়িয়েছিলেন নিসর্গে আর তারপর তার স্থিতি পরম পূজনীয় বিধাতায়। ঈশ্বরবাদে স্থিত ফজল নিজেকে শনাক্ত করে গেছেন একজন দ্রুতগামী অশ্বারোহী হিসেবে যিনি আকাশবিহীন আকাশের দিকে বিশাল আলোর আবর্তে ক্রমধাবমান।

ফজল জাগতিক ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কাম এবং প্রজননের সঙ্গে মিশে থাকতে চেয়েছিলেন চিরকালের শব্দসংগীতের মতো। স্বপ্নাশ্রয়ী ফজল স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন স্বপ্নাকাশে নক্ষত্র হয়ে মেঘ হয়ে ভেসে থাকতে। ফজলের অস্তিত্বে ও স্মৃতিতে চির উন্মুখ ছিল তার সেই নারী। যার জন্য বৃষ্টিময় দিনে তার এ আকুল আকুতি, এই নিবিড় প্রেমোচ্চারণ—

‘তোকে মনে পড়ে এই বৃষ্টিভরা দিনে
তুই এক অগ্নিময় স্মৃতি
আমার অস্তিত্বে একা উন্মথিত দুর্লভ প্রতীতি
অধুনা প্রাচীনে।’

চিরবসন্তের এই কবি বসন্ত বাতাসকে পায়ে পায়ে দলে দলে বহু সহযোদ্ধাকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন।