দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : আমাদের আলোচনার আগের পর্বে এসেছে ১৯৫১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ। এবার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বছরটির অন্যান্য মাসের ভাষার দাবি সম্বলিত বিভিন্ন ঘটনাসহ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরব।

ফেব্রুয়ারির ১৫ ও ১৬ তারিখে রংপুর টাউন হলে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী পয়লা এপ্রিল থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট একটানা ৪৫ দিন চলে। ২৬ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটির বৈঠকে সর্ব প্রথম পূর্ব-বাংলার ওপর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অব্যাহত লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি ড. মুহম্মহ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ও কাজী মোতাহার হোসেনসহ পূর্ব-বাংলা পরিষদ-সদস্য, গণপরিষদ সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী, লেখক, শিল্পী ও ছাত্রসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের কাছে বাংলাকে ১ এপ্রিল থেকে সরকারি ভাষারূপে চালু করার জন্য একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এটা নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নুরুল আমীনের তর্ক-বিতর্ক হয়।

মার্চের ১৬ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে একই ধরনের দাবি ওঠে। এখানে পূর্ব-বাংলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি জোর দেওয়া হয়। এ সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন, অধ্যাপক আবুল ফজল। সম্মেলন উদ্বোধন করেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল।

বছরের রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ২৭ ও ২৮ মার্চের পাকিস্তান যুব সম্মেলন। বেশ কড়াকড়ির মধ্য দিয়ে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা পাকিস্তান আন্দোলনের কারণগুলো তুলে ধরে বলেন, সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে নিজের দেশের জনগণকে রক্ষা করতে সুখী ও সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়তে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি। এখানে ইসলামের নামে জনগণকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমালোচনা করলেই কমিউনিস্ট আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তারা ১৪টি দাবি পেশ করেন। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল- এই প্রস্তাবনা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বিরাজিত নিপীড়নের বিরুদ্ধে নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক প্রস্তাবনা ছিল এটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের কাছে ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রভাষার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এই দাবি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের কাছে কোনো আবেদন রাখেনি। কিন্তু ওই অঞ্চলের সংবাদপত্রে বিষয়টি আলোচিত হয়। বিখ্যাত ডন পত্রিকা পরোক্ষভাবে দাবিটিকে সমর্থন করে। ২০ এপ্রিল পেশোয়ারের খাইবার মেইল তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখে- ‘বাংলা ভাষার দাবি অবহেলা করা যায় না। আমরা মনে করি, বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকেই পাকিস্তানের সরকারি ভাষারূপে স্বীকার করা উচিত।’

এদিকে ১৫ এপ্রিল করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান উর্দু সম্মেলনে এর বিপরীতে অনেকে মত দেন। সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা আকরম খাঁ। এখানে ধর্মরক্ষার নামে উর্দুর পক্ষে অনেকে কথা বলেন। তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ১৮ এপ্রিল এক প্রতিবাদী সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘রিপোর্ট অনুযায়ী মওলানা আকরম খাঁ উর্দু সম্মেলনে বলছেন যে, যারা উর্দুর বিরোধিতা করে তারা ইসলামের শত্রু। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তিনি এই শত্রুদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করেন।’

এ ছাড়া আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি জুলাই, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পৃথক সমাবেশ করে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এই সময়ের সমাবেশগুলোতে কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, গাজীউল হক প্রমুখ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এ সময়ের আরও কিছু ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ববঙ্গে মানুষ তখন খাদ্যসংকট, লবণসংকট ও পাটের বাজার মন্দাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। অন্যান্য আন্দোলনের মধ্যে ছিল চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আন্দোলন, ভুখামিছিল, অর্থনৈতিক মন্দা এবং সেই সঙ্গে ছিল সরকারি দমননীতি ও নির্যাতন।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৪)