শিশু শোয়েবের পেটে বাচ্চা!
মাত্র সাত মাস বয়সী শিশু শোয়েবের পেটে তিল তিল করে বাড়ছিল আরেকটি মানব শরীর! বিষয়টি অনেকটা পুরুষের গর্ভধারণের মতো! নারীর গর্ভে সন্তান জন্ম নেওয়ার প্রচলিত নিয়মের বাইরে বেড়ে ওঠা এ মানব শরীরটি শিশু শোয়েবের মায়েরই দ্বিতীয় একটি সন্তান! অবশেষে গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাক্তার শফিকুল হকের নেতৃত্বে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শোয়েবের পেট থেকে অপসারণ করা হয় এ মানব শরীরটিকে।
বিএসএমএমইউ’র ব্লক-সি শিশু বিভাগের ষষ্ঠ তলায় শিশু ওয়ার্ডে শনিবার বিকেলে কথা হয় শোয়েবের বাবার সঙ্গে। তবে সাংবাদিক পরিচয় দিলে শোয়েবের বাবা নিজের নাম ও বসবাসের ঠিকানা প্রকাশ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘শোয়েব আমার দ্বিতীয় সন্তান। শোয়েব তার মা লুৎফুন্নাহারের গর্ভে থাকা অবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। তখন ডাক্তার আমাদের বলেছিলেন, গর্ভের বাচ্চার (শোয়েব) পেটে একটি টিউমার রয়েছে। জন্মের পর ডাক্তারের পরামর্শে অপারেশন করে টিউমারটি ফেলে দেওয়া যাবে বলে আমাদের জানানো হয়।’
শোয়েবের বাবা আরও বলেন, ‘শোয়েবের জন্মের পর ওর শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি বা অস্বাভাবিক কোনো আচরণও করেনি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর পেট বড় হতে থাকে। এরপর আমরা পিজি হাসপাতালে শিশু বিভাগে যোগাযোগ করলে ডাক্তার আমাদের বলে শোয়েবের পেটে আরেকটি বাচ্চা রয়েছে। তবে সেটি জীবিত নয়। এরপর গত পরশু (বৃহস্পতিবার) অপারেশন করা হয়। শোয়েব এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।’
পুরুষের শরীরে আরেকটি মানব শরীর বেড়ে ওঠার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অস্ত্রোপচারকারী ডা. অধ্যাপক শফিকুল হক বলেন, ‘শোয়েব জন্ম নেওয়ার আগে তার পেটে একটি টিউমার ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে পারি এটা টিউমার নয়, এটা আরেকটি মানব শরীর।’
শফিকুল হক আরও বলেন, ‘জমজ শিশু জন্ম নেওয়ার ঘটনাটি স্বাভাবিক একটি বিষয়। যখন একজন মায়ের গর্ভে একইসঙ্গে দুই বা দুইয়ের অধিক ভ্রুণ সৃষ্টি হয় তখন জমজ শিশু জন্ম নেয়। তবে কখনও কখনও গর্ভধারণের চার মাসের মধ্যে একটি ভ্রুণ আরেকটি ভ্রুণের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। ফলে প্রথম ভ্রুণটি মানব শরীরে রূপান্তর হলেও দ্বিতীয়টি ওই মানব শরীরের মধ্যে থেকে যায়। তখন দ্বিতীয় ভ্রুণটি প্রথমটির শরীরের একটি অতিরিক্ত অংশে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভ্রুণে কোনো জীবনের সৃষ্টি হয় না। এটি প্রথমটির শরীরের রক্ত চলাচলের মাধ্যমে টিকে থাকে। শোয়েবের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। শোয়েব ওর মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় আরেকটি ভ্রুণ শোয়েবের শরীরে ঢুকে যায়। যা শোয়েবের জন্মের পর অতিরিক্ত অংশ বা টিউমার হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটা কোনো জটিল বিষয় না। এ ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটে। তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত ভ্রুণটি অপসারণ করা সম্ভব। আমরা শোয়েবের শরীর থেকে অতিরিক্ত ভ্রুণটি সফলভাবে অপসারণ করতে পেরেছি।’
বিষয়টি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘একজন মা গর্ভধারণের প্রথম পর্যায়ে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে ভ্রুণ জন্ম নেয়। স্বাভাবিকভাবে একটি ভ্রুণই জন্ম নেয়। কিন্তু জমজ শিশু জন্মের ক্ষেত্রে মায়ের শরীরে একাধিক ভ্রুণের সৃষ্টি হয়। তবে যেকোনো কারণে দুটি ভ্রুণের একটি গর্ভাশয়ে না থেকে অন্য ভ্রুণের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘ফেটাস ইন ফেটো’ বলে। তবে যে ভ্রুণটি অন্য একটি ভ্রুণের মধ্যে ঢুকে গেল সেটিতে আর জীবনের সৃষ্টি হয় না। এটি পরবর্তী সময়ে শরীরের অতিরিক্ত অংশ বা টিউমার হিসেবে থেকে যায়।’
ডা. কাজল বলেন, ‘এর আগে বগুড়ার ৪২ বছর বয়সী মালেক নামের একজনের পেটে এমনই একটি মানব শরীর পাওয়া যায়। যেটি শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করেছিলেন। মালেকের ক্ষেত্রে যে ভ্রুণটি তার পেটে ছিল সেটিতে হাড়, মাংস এমনকি লোমও ছিল। এই অতিরিক্ত অংশটি মালেকের শরীরের রক্ত চলাচলের মাধ্যমেই বেঁচেছিল। তবে পরিপূর্ণ মানুষের অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ এই ভ্রুণটিতে ছিল না। তাই এটিকে আমরা মানুষ বলতে পারি না।’বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো এমন ঘটনা ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একইসঙ্গে সাত মাস বয়সী শোয়েবের শরীর থেকে সফলভাবে অতিরিক্ত এই ভ্রুণটি অপসারণ করার কৃতিত্বও পুরোপুরি বিএসএমএমইউ’র।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ডা. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল মজিদ ভূঁইয়া দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শোয়েবের মতো এ ধরনের ঘটনায় অনেকেই না বুঝে পত্র-পত্রিকায় লিখছেন পুরুষের গর্ভে সন্তান। আসলে শোয়েবের পেটে যে মানব শরীর পাওয়া গেছে এটি একটি ভ্রুণ মাত্র। এটিকে পরিপূর্ণ মানুষ বলা যাবে না। শোয়েবের শরীরে যে ভ্রুণটি ঢুকে গিয়েছিল এটি এক ধরনের টিউমার যাকে আমরা বলি টেরাটোমা। এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের বহু দেশে ঘটে থাকে। আমাদের দেশেও এমন ঘটনা খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। মানব শরীরের মধ্যে আরেকটি ভ্রুণ ঢুকে টিউমার সৃষ্টি হলে প্রথমে তা কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেট বড় হতে থাকলে বিষয়টি ধরা পড়ে। অজ্ঞতার কারণে অনেকে কবিরাজ-ফকিরের মাধ্যমে এ সবের চিকিৎসা করান। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা জটিল কিছু না। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এ ধরনের টিউমার অপসারণ করা সম্ভব।’
ছবি : শাহীন ভূঁইয়া
(দ্য রিপোর্ট/আরএইচ/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৪)