সাংহাই সিটি’র আদলে চট্টগ্রামে উপশহর
সাইফুল ইসলাম শিল্পী, দ্য রিপোর্ট : চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তলদেশে স্বপ্নের টানেল নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরে। এ টানেল নির্মাণের মধ্য দিয়ে বন্দর নগরীর কর্ণফুলীর ওপারে গড়ে উঠবে চীনের ‘সাংহাই সিটি’র আদলে আরেকটি উপশহর এবং পূরণ হবে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের স্বপ্ন।
চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর ও চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এ টানেল নির্মাণের স্বপ্ন পূরণের অগ্রগতি হয়েছে বলে আশাবাদী চট্টগ্রামবাসী।
চীনের সাংহাই মহানগরীর ‘এক নগরী দুটি টানেল’ অনুসরণে দেশের প্রথম এ টানেলের নকশা করা হয়েছে। নদীর তলদেশ দিয়ে এই ‘মাল্টিলেন টানেল’-এর পথটির একপাশে নৌবাহিনী কলেজ, অপরপাশে কোরিয়ান রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (কেইউপিজেড) ও কর্ণফুলী সার কারখানা (কাফকো) রয়েছে।
টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দর ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। বন্দর নগরী ও কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগ, বিশেষত কর্ণফুলী নদীর ওপর দুটি সেতুতে যানবাহন চলাচল সহজ করবে।
শুধু ট্যানেল নির্মাণ নয়, চীনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত হচ্ছে আরো ২টি বৃহত্তর প্রকল্প। সেগুলো হচ্ছে আনোয়ারায় চীনা ইকোনমিক জোন ও বাশঁখালীতে বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পগ্রুপ এস আলমের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এরমধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ও ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলীর ওপারে আনোয়ারায় চীনা ইকোনমিক জোন এবং ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাশঁখালীতে নির্মিত হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদুৎপ্রকল্প।
সূত্র মতে, টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে তার মধ্যে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকাই ঋণ সহায়তা দেবে চীন। স্বপ্নের এই টানেল নিয়ে নতুন করে আশার আলো দেখছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা গোটা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে এই টানেল।
নদীর তলদেশে যোগাযোগের এই একটি পথ বদলে দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি।
এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘চীনের সাংহাই সিটির মতো চট্টগ্রাম নগরীতে পরিকল্পিত দুটি শহর গড়ে তুলতে চায় সরকার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই বছরেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। নির্ধারিত সময়ে (চার বছর) নির্মাণকাজ শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদাও পূরণ হলো।’
তিনি জানান, দুই কিলোমিটার নিম্ন স্রোত থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। টানেলটি একই সঙ্গে ন্যাশনাল হাইওয়ে ও এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
নগরীর নেভাল একাডেমি থেকে কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার) পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণ করা হবে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, কর্ণফুলী নদীর ওপর বর্তমানে দুটি ব্রিজ রয়েছে। এতে নদীতে প্রতিনিয়ত সিলটেশন (পলি জমা) হচ্ছে। নদীর নাব্যতা রক্ষার স্বার্থে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব নয়। আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ করলে বন্দর ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্রিজ নির্মাণ না করেই টানেল নির্মাণের মাধ্যমে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিক রাখা হবে। টানেল হলে বন্দরের কাজে গতিশীলতা বাড়বে। দ্রুত মালামাল বন্দরে ঢুকতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, টানেল নির্মিত হলে ওই পাড়ে গড়ে উঠবে আরেকটি শহর। যেখানে শিল্প কারখানাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও নদীর ওপারে সম্প্রসারিত হবে। স্বাভাবিকভাবে নগরীর উত্তরাংশের ওপর চাপ কমবে। ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিসি এবং হংকংয়ের অরূপ নামের দুইটি প্রতিষ্ঠান টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে অ্যালাইনমেন্ট তৈরি করেছে। জি টু জি’র (সরকার থেকে সরকার) মাধ্যমে টানেল নির্মাণ করা হবে।
শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিমত কর্ণফুলীর তলদেশে এ টানেল নির্মাণ চীন বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে স্বপ্নপূরণের পথে একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। চট্টগ্রামকে ঘিরে এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুধু বন্দর নগরী নয় বদলে যাবে গোটা দেশের চেহারা।
দেশের বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা অঞ্জনশেখর দাশ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য যোগাযোগ একটি বড় মাধ্যম। কানেক্টিভিটি একটি বিশাল ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছে এ টানেল নির্মিত হলে গোটা দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে বিনিয়োগে আগ্রহী চায়নিজরা। তারা বিশাল আকারে বিনিযোগ করতে চাচ্ছে। ইন্ডিয়াও বিনিয়োগে অগ্রহী। তাই এ টানেল এখন অতীব গুরুত্ব।
টানেল নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ইফতেখার কবির দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোরকে জানান, সার্ভেসহ সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরেই শুরু হবে মূল নির্মাণ কাজ। দুই টিউব বিশিষ্ট এ টানেল নির্মাণ করা হবে। একটি টিউবে দুটি করে লেইন থাকবে। এর মধ্যে একটিতে যাবে অন্যটিতে আসবে।
চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটির নদীর অংশ ১১শ মিটার।
কর্তৃপক্ষ আশা করছে, দুই পাশে সংযোগ সড়কসহ সব নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২০ সালের মধ্যে। বলা হচ্ছে, টানেলকে ঘিরে নদীর দক্ষিণপাড়ে নগর সম্প্রসারণের পাশাপাশি খুলে যাবে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা। হবে শিল্পায়ন। মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সড়কপথে বাংলাদেশের যুক্ত হবার যে অপার সম্ভাবনা, তারও মাধ্যম হতে পারে এই টানেল।
(দ্য রিপোর্ট/এপি/অক্টোবর ১৫, ২০১৬)