চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি আধুনিক যুগে সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণকারী ব্যাংক ডাকাতিগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর তদন্তের দায়ভার পরেছে পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) উপর। ঘটনার তদন্তে সামনে এগুতে সিআইডির প্রয়োজন অভিযুক্ত বিদেশির সম্পূর্ণ তথ্য-উপাত্ত। তা না হলে তদন্তের চার্জশিট দিতে পারছে না তারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রিজার্ভ চুরি বা হ্যাকের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বেশিরভাগরই অবস্থান দেশের বাইরে। তবে দেশের ভেতর বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত। যে সকল দেশের নাগরিক এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে পেরেছে সিআইডি। তবে তাদের পুরোপুরি শনাক্ত করার জন্য ওই সকল দেশের পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন। যতক্ষণ না দায়ী ব্যক্তিদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য ওই সকল দেশের পুলিশ দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মামলার চার্জশিট দিতে পারছে না সিআইডি।

ওই সাইবার চুরির ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদনটি দিয়েছে তা এখনও প্রকাশ করেনি সরকার। সর্বশেষ গত মাসে প্রতিবেদন প্রকাশের কথা থাকলেও তা হয়নি।

রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্ধ-শতাধিকের বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে এরই মধ্যে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এখনো বেশ কয়েকজনকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদনে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নাম থাকবে না, তা নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে জানান, তদন্ত কাজ শুরুর পর থেকে গত সাত মাসে ইন্টারপোলের আয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পুলিশবাহিনীর সঙ্গে চারদফা বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু এখনো রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদেশিদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় নি। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর ইন্টারপোলের আয়োজনে সিঙ্গাপুরে একটি বৈঠকে অংশ নেয় সিআইডির দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল। সেখানে ৬টি দেশ ও দুটি সংস্থার সর্বমোট ২৫ জন সদস্য অংশ নেয়। সংস্থাগুলোর মধ্যে ছিল— বিশ্ব ব্যাংক ও ইন্টারপোল।

তিনি আরও বলেন, ইন্টারপোলের বৈঠকে বিদেশি অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি, কিন্তু পরিপূর্ণ তথ্য হাতে পাইনি। সম্পৃক্ত সকলের তথ্য পেলেই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। হয়তো ইন্টারপোলের পরবর্তী বৈঠকে আরও কিছু অপরাধীর তথ্য পাওয়া যেতে পারে। বৈঠকের তারিখ নির্ধারণের একমাস আগে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী বৈঠকের দিন এখনো নির্ধারিত হয়নি।

অবশ্য, রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কেউ জড়িত, এমন দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জড়িত অন্তত একজনের ব্যাপারে তথ্যপ্রমাণ এফবিআইয়ের এজেন্টরা পেয়েছেন বলেও জানানো হয়। রিজার্ভ চুরি তদন্ত সংশ্লিষ্ট এফবিআইয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের গত ১০ মে তারিখের সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ চুরি-সংক্রান্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত তারা পেয়েছে, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন কর্মকর্তা এতে জড়িত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে, এর পেছনে আরও অনেকেই আছেন, যারা অপরাধীদের বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে প্রবেশে সহায়তা করেছেন।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আব্দুল্লাহেল বাকী দ্য রিপোর্টকে জানান, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইন, চায়না, ম্যাকাও, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও ভারতের কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গিয়েছে। তাদের সম্পর্কে তথ্য জানতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে ওই সব দেশের প্রতিনিধিরা আসবেন। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত এগুবে। এ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজনদের অফিসিয়ালভাবে সম্পূর্ণ তথ্য-পরিচয় প্রয়োজন। এগুলো পেলেই তদন্ত পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে।

এদিকে, সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সংবাদ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট প্রশ্ন তুলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এক মাস পর্যন্ত সাইবার ডাকাতির তথ্যটি গোপন করেছিল? ব্যাংক কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা, ভবিষ্যতে কিভাবে এ ধরনের সাইবার ডাকাতি ঠেকানো যাবে তা নির্ধারণ করাই ছিল ওই তদন্ত কমিটির কাজ। ইকোনমিস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করবেন না। সাইবার ডাকাতির পর থেকে অবিরতভাবে বহিরাগত হ্যাকার, নিউইয়র্ক ফেডারেল এবং সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফটকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে সাইবার ডাকাতরা সুইফট কোড ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে টাকা সরিয়ে নিতে পারলো সে ব্যাখ্যা এখনও কেউ দিতে পারেননি। কিংবা নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভও সেই কোড শনাক্ত করতে কেন ব্যর্থ হলো তার সুরাহাও পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম হ্যাক করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে অবস্থান না করেই ট্রান্সফার অর্ডার দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। যদি তা সত্যি হয়, তবে এটি বিশ্বের লেনদেন ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে এ সাইবার ডাকাতির ক্ষেত্রে হ্যাকারদের সঙ্গে সুইফট টার্মিনালের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার এখনও চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইন থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিপাইনি প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুয়ার্তে এ ব্যাপারে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনের একটি আদালত থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয় (চুরি যাওয়া অর্থের কিছু অংশ ব্যাংকটি উদ্ধার করতে পেরেছিল)। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফিলিপিনো কর্মকর্তারা হয়তো আশা করছেন বাংলাদেশিরা তাদের টাকা ফেরত নেবে এবং তারা শান্তিতে থাকবেন। তবে ফিলিপাইনে অর্থ পাচার সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতির বিপরীতে এ অর্থ নিতান্তই কম বলে উল্লেখ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, বৈঠকে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত ফিলিপাইনের ৩০ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করার আহ্বান জানিয়েছি। তারাও আমাদের আশ্বস্ত করেছে খুব শীঘ্রই রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের নিজ দেশে প্রচলিত আইনে বিচার করা হবে।

তিনি আরও বলেন, মাঠ পর্যায়ের অপরাধীদের আমরা শনাক্ত করেছি। এখন ওই সব অপরাধীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করা হচ্ছে। ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, শীঘ্রই অপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমরা পেয়ে যাব। সিআইডির তদন্তের বিষয়টি কিন্তু বিচারিক বিষয়। এটা শুধু প্রতিবেদন দেওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ না। এ ছাড়াও বিদেশি অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করাটা তো একটু সময় সাপেক্ষ বিষয়। এ সব কারণেই প্রতিবেদন দিতে একটু সময় লাগছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সুইফট কোড হ্যাক করে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। তবে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে মার্চের শুরুতে। পরে ১৫ মার্চ এ ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ এবং তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশে ওই মামলার তদন্তভার পেয়ে দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে কাজ শুরু করে সিআইডি। একটি অংশ রিজার্ভ চুরির সাথে জড়িত দেশিয় সূত্রগুলোকে নিয়ে তদন্ত করতে থাকে। আরেকটি অংশ রির্জাভ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদেশি সূত্রগুলো নিয়ে কাজ করছে। ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনায় চাপের মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব এম আসলাম আলমকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে ফজলে কবিরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। সময় মতো প্রতিবেদন জমা দেয় মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। কমিটির অপর দুই সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস। এ কমিটি গত ৩০ মে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার প্রবেশ করে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি)। এর মধ্যে আরসিবিসিতে খোলা এনরিকো তিয়োদরো ভাসকুয়েজের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। কাঁচপুর, মেঘনা-গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ প্রকল্পে জাইকা থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের নামে এ অর্থ যায় অ্যাকাউন্টটিতে। জেসি ক্রিস্টোফার ল্যাগ্রোসাসের নামে খোলা আরেকটি অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে ৩ কোটি ডলার। ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বিপরীতে জাইকার ঋণ পরিশোধের নামে ছাড় হয় এ অর্থ। এ ছাড়া পরামর্শক ফির নামে মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে ৬০ লাখ ডলার। আলফ্রেড সান্তোস ভারজারার অ্যাকাউন্টে ঢোকে এক কোটি ৯০ লাখ ডলার। ভেড়ামারা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং ফির নামে এ অর্থ প্রবেশ করে ভারজারার অ্যাকাউন্টে।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/জেডটি/এনআই/অক্টোবর ১৭, ২০১৬)