উপজেলা নির্বাচন
আ’লীগে অস্বস্তি, বেকায়দায় বিএনপি আর মরিয়া জামায়াত
আসন্ন চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সরকার এক ধরনের নৈতিক বৈধতা পাচ্ছে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল। অন্যদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে থাকায় অস্বস্তিতে ভুগছে আওয়ামী লীগ।
আর সদ্য জাতীয় নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করতে না পেরে বিপাকে পড়েছে। একক প্রার্থী নির্ধারণেও হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে তফসিল ঘোষিত প্রায় সব উপজেলাতেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচনী লড়াইয়ে আছেন।
অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী উপজেলা নির্বাচনে চমক দেখাতে চায়। দলের চরম ক্রান্তিকালে উপজেলা নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে তারা। ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য প্রথম দফার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনে ২৮টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে জামায়াত। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৫টিতে জয় পেতে মরিয়া দলটি।
উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আমানউল্লাহ আমান, তারেক সালমান, মাহমুদুল হাসান ও কাওসার আজম
আওয়ামী লীগে অস্বস্তি
দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে থাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। দলটির একাধিক নীতি-নির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে নৈতিকভাবে বৈধতা দিয়েছে। এতে সরকারের অস্বস্তি অনেকটা দূর হয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পাশাপাশি বিএনপির অংশগ্রহণে নতুন করে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে রেকর্ডসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। দলটির প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বিদ্রোহী ঠেকাতে বেশ কয়েক দফা সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সব পদক্ষেপই ব্যর্থ হওয়ায় অনেকটা নিরূপায় হয়ে পড়ছে আওয়ামী লীগ। ফলে দল সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে স্থানীয় পর্যায় থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারও করা হচ্ছে।
এদিকে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারকে বৈধতা দিচ্ছে বলেও মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এক অনুষ্ঠানে বলেন, নাকে খত দিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বিএনপি বার বার অবৈধ বললেও এখন সে অবৈধ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অর্থাৎ বিএনপি বর্তমান সরকারের বৈধতা মেনে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই।’
সূত্র জানায়, এ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ নেওয়ায় তিন পদেই একক প্রার্থী দিতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা মৌখিক নির্দেশ দেন। এতে কাজ না হওয়ায় একই নির্দেশনা দিয়ে সব জেলায় শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয়। নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে দল থেকে বহিষ্কারসহ শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় ওই চিঠিতে। তাতেও হালে পানি না পেয়ে অবশেষে কেন্দ্রীয়ভাবে সাত বিভাগে কেন্দ্রীয় ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সমন্বয়ে সাতটি টিম পাঠানো হয়। তারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাহারের জন্য সর্বোচ্চ চাপ দেয়। এতেও কাজ না হওয়ায় এখন সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে আওয়ামী লীগ।
সূত্রমতে, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ায় আওয়ামী লীগকে কঠিন ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। যে সব এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে সব স্থানেই বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসবভন গণভবনে বুধবার সন্ধ্যায় দলের কার্যনির্বাহী সংসদের এক জরুরি সভায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, ওই বৈঠকে সর্বপ্রথম বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রসঙ্গ তোলেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এরপর এটি নিয়ে বেশ উত্তপ্ত আলোচনা হয়। এ সময় অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা নির্বাচন সমন্বয়ক বিএম মোজাম্মেল হক দ্য রিপোর্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কোনো দল যদি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে তাতে আওয়ামী লীগ তাদের অভিনন্দন জানাবে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আওয়ামী লীগের অস্বস্তিতে পড়ার কিছু নেই।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। দলে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকতেই পারে। যেভাবে বিদ্রোহী প্রার্থী আছে বলা হচ্ছে, ততটা নয়। তবে আমরা আশা করছি নির্বাচনের আগেই যে দুই-একটি জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থী আছে সেগুলোও সমাধান হবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ভুল বুঝতে পেরে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় অনেক ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ওই ভোটারদের থামিয়ে রাখতে পারবে না বুঝতে পেরেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও আমরা বিএনপিকে অভিনন্দন জানাতাম। বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অনেক ভালো হয়েছে। বিএনপির কর্মকাণ্ডের জবাব দেবে দেশের জনগণ।
বেকায়দায় বিএনপি!
কেন্দ্র থেকে প্রচেষ্টা ও নির্দেশনা থাকলেও উপজেলা নির্বাচনে একক প্রার্থী নির্ধারণে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে তফসিল ঘোষিত প্রায় সব উপজেলাতেই দলের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীদের কোনোমতেই বাগে আনতে পারছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। যে কারণে প্রথম পর্বের ৯৭টি উপজেলার মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের সামাল দিতে দলটিকে ইতোমধ্যেই অর্ধশতের বেশি নেতাকে বহিষ্কার করতে হয়েছে।
প্রার্থী নির্ধারণে জটিলতা সম্পর্কে বিএনপির উপজেলা নির্বাচন মনিটরিং সেলের সদস্য, দলের যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনকে পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজি হিসেবে গ্রহণ করেছে বিএনপি। এই নির্বাচন সরকারের জন্য অ্যাসিড টেস্ট। নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে প্রথম পর্বের ৯৭টি উপজেলার মধ্যে বিএনপি ও ১৯ দলীয় জোটের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫টিতে। অন্যদিকে সরকার যদি ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের অপচেষ্টা চালায়, তবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিএনপি তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
শাহজাহান বলেন, ‘জোটের শরিক জামায়াতকে ছাড় দেওয়ার কোনো বিষয় নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় নেতারাই তাদের প্রার্থিতা নির্ধারণ করেন। যেখানে যার বা যে দলের নেতার গ্রহণযোগ্যতা বেশি, ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে যে প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসবেন, সেখানে তাদেরই বা সেই দলের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিচ্ছে ১৯ দলীয় জোট।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তাই দল বা কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়ার আসলে কিছুই নেই। তবে স্থানীয় জোট নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐকমত্যের প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন। প্রার্থী নির্ধারণে যেসব উপজেলায় বেশি জটিলতা, কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা সেখানে চেষ্টা করেছি জটিলতা নিরসনে। আশা করি দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে একাধিক বা বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না। তিনি বলেন, একাধিক বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের অত্যন্ত ‘সফটভাবে’ বুঝিয়ে একক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছি। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে বেশিরভাগই জেলা নেতাদের সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়েছে।’
বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একক প্রার্থী নির্ধারণে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দলটি। অধিকাংশ উপজেলায় বিএনপির একাধিক এবং জোটের শরিক জামায়াতের প্রার্থী রয়েছেন। ফলে বিদ্রোহ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে। মাঠ-রাজনীতিতে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে বিএনপি ও দলটির অন্যতম জোট জামায়াত। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে পরস্পর-পরস্পরকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে হলেও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী ও প্রার্থীরা এ সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। একাধিক উপজেলায় কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা। মাঠ-নেতাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বিদ্রোহ দমনে কয়েক উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে গেছে।
জানা গেছে, প্রথম পর্বের ৯৭টি উপজেলার মধ্যে জামায়াতকে ১৪টি উপজেলায় সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্দেশে এ ছাড় দিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা বিএনপি। কিন্তু ওই ১৪টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন স্থানীয় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরা। দ্বিতীয় দফায় ১১৭ উপজেলা নির্বাচনে একাধিক জায়গায় দুই দলের প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ দফায় ৫টিতে জামায়াতকে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। তবে ২৮ উপজেলায় জামায়াত ও বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জে জোটের সিদ্ধান্তে বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দেয় জামায়াত। কাহালুতে বিএনপি ছাড় না দেওয়ায় শিবগঞ্জে জামায়াত বিদ্রোহ করেছে। অপরদিকে সমঝোতার উদাহরণও রয়েছে। কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও রামুতে সমর্থন পাওয়ার শর্তে পেকুয়া, চকরিয়া ও মহেশখালীতে কোনো প্রার্থী দেয়নি জামায়াত।
বগুড়ার শাজাহানপুর, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল, দিনাজপুরের বিরামপুর, বীরগঞ্জ, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কুড়িগ্রামের রাজীবপুর, জয়পুরহাট সদর, কালাই, নাটোরের সদর, গুরুদাসপুর, লালপুর, কুষ্টিয়ার খোকসা, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর, রাজশাহীর বাঘা, মেহেরপুরের গাংনী, ঝিনাইদহের মহেশপুর, বাগেরহাটের ফকিরহাট, খুলনার ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী রয়েছেন।
অর্ধশত নেতা বহিষ্কার : বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় ৬ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মুন্সী কামাল আজাদ পান্নুকে বহিষ্কার করে জেলা বিএনপি। একই দিন বহিষ্কৃত হন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি এম কে আজাদ ও উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এসএম রবিউল ফারুক। ৮ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোখলেছুর রহমান, প্রচার সম্পাদক আবদুল মমিন, সদস্য আবদুল কাদের মাস্টার, মফিজুল ইসলাম ও পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হককে বহিষ্কার করা হয়। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া এবং জেলার প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় ১০ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা রফিকুর রহমানকে এবং বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপি সভাপতি ইমাম হাসান আবু চানকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। ১১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও রামগড় উপজেলা চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া বহিষ্কৃত হন। একই দিন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ায় জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাম শওকত সিরাজকে এবং মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ায় শহর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাউদ্দিন খান স্বপনকে বহিষ্কার করা হয়। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় নাটোর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য সিরাজুল ইসলাম, গুরুদাসপুর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আয়নাল হক তালুকদার ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আযমকে ১২ ফেব্রুয়ারি দল থেকে বহিষ্কার করে জেলা বিএনপি। একই দিন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় পাবনার চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রহিম কালু, ভাঙ্গুরা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুর মোজাহিদ স্বপন ও সাঁথিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সালাউদ্দিন খানকে বহিষ্কার করে জেলা বিএনপি।
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দলের স্বার্থবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি ৫ নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। বহিষ্কৃতরা হলেন- বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি লোকমান হোসেন খাঁন, বিএনপি নেতা নূর আলম এবং হান্নান শরীফ। সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী দিনের আন্দোলন কর্মসূচি। উপজেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আন্দোলনের ধরন হবে এক রকম। অন্যদিকে না পেলে রাজপথের আন্দোলনের চিত্রও পাল্টে যাবে। উপজেলা নির্বাচনের জয় তৃণমূলের হতাশা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানোতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিকভাবেও বিএনপির জনপ্রিয়তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। জিতলে তৃণমূলের চাঙ্গাভাব পরবর্তী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে।
১৫টিতে জয় পেতে মরিয়া জামায়াত
মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে চমক দেখাতে চায়। দলের চরম ক্রান্তিকালে উপজেলা নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে তারা। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য প্রথম দফার নির্বাচনে ২৮টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে জামায়াত। এর মধ্যে ২০টিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলে কমপক্ষে ১৫টিতে জয় পেতে চায় দলটি।
একইভাবে ২৬টিতে ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১২টিতে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিয়েছে দলটি। এর মধ্যে ১৪টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে তাদের। বাকিগুলোতে বিএনপি ও জামায়াত আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করছে।
জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে। তবে নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পাশাপাশি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও জোটের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে জামায়াত প্রার্থীদের।
জামায়াত সূত্র জানায়, নির্বাচনে কমপক্ষে ১৫টি উপজেলায় চেয়ারম্যান, ১৭টিতে ভাইস চেয়ারম্যান এবং ৮-১০টিতে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মাঠে নেমেছে জামায়াত। এ জন্য কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলার নেতাদের নিয়ে একাধিক সেল গঠন করেছে দলটি। দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বিএনপির সঙ্গে সমন্বয়সহ বিভিন্ন কৌশলে কাজ করছে তারা।
যে ১৪টিতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা হয়েছে সে সব উপজেলার মধ্যে বেশ কয়েকটিতে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী এখনও মাঠে রয়েছেন। যেসব উপজেলায় প্রার্থী দেওয়া হয়েছে সেখানে স্থানীয়ভাবে জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে বলে দাবি জামায়াতের। এ সবের মধ্যে ৮-১০টিতে জামায়াত সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান রয়েছেন।
কুষ্টিয়ার তিনটি উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় জামায়াতকে ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। এখানে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নীলফামারীতে তিনটি উপজেলার মধ্যে ডিমলা উপজেলায় জামায়াত প্রার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। সেখানে নির্বাচন করছেন মাওলানা আব্দুস সাত্তার। এ ছাড়া জলঢাকা উপজেলাতে জামায়াতের স্থানীয় নেতা মো. সৈয়দ আলী নির্বাচন করছেন। এখানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীও রয়েছেন।
পঞ্চগড়ের ৪টি উপজেলার মধ্যে তিনটিতেই প্রার্থী দিয়েছে জামায়াত। সদর উপজেলায় বর্তমান চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল খালেক, দেবীগঞ্জে অধ্যাপক আব্দুল মান্নান এবং বোদা উপজেলায় মো. শফিউল্লাহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে অধ্যাপক আজিজুর রহমান, রংপুরের মিঠাপুকুরে অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় ওলিউর রহমান, কোটচাঁদপুর উপজেলায় তাজুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, রাজশাহীর মোহনপুরে ইসমাইল হোসেন, নাটোরের সিংড়ায় বেলাল উজ্জামান, সাতক্ষীরার আশাশুনিতে মুর্তজা আলী, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন, পাবনার সাঁথিয়ায় মোখলেছুর রহমান, আটঘরিয়ায় মাওলানা জহুরুল ইসলাম, খুলনার কয়রা উপজেলায় আ খ ম তমিজ উদ্দিন, নরসিংদীর পলাশে মাওলানা হেলাল উদ্দীন, শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে মাওলানা নাসির হোসেন, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. আব্দুল কুদ্দুস, ছাতকে রেজাউল করিম, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় প্রকৌশলী আলকাছ আল মামুন, সিলেটের জৈন্তাপুরে জয়নাল আবেদীন, গোয়াইনঘাটে আনোয়ার হোসেন, জকিগঞ্জে নিজাম উদ্দিন খান, বিশ্বনাথে নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী ও গোলাপগঞ্জে হাফেজ নাজমুল ইসলাম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সিরাজগঞ্জের চারটি উপজেলার মধ্যে তিনটিতেই প্রার্থী রয়েছে জামায়াতের। তিনটির কোনোটিতেও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা হয়নি। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, উল্লাপাড়া উপজেলায় অ্যাডভোকেট জাহিদ হাসান মিন্টু এবং রায়গঞ্জ উপজেলায় বর্তমান চেয়ারম্যান এবিএম আব্দুস সাত্তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এদিকে বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়ার ছয়টি উপজেলার মধ্যে তিনটিতে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। তবে মাঠে রয়েছেন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরাও। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল গণি মণ্ডল, নন্দিগ্রামে নুরুল ইসলাম মণ্ডল ও শেরপুরে দবির উদ্দিন প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলনা শাহীনুর ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সমঝোতার ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন আগ্রহ দেখানো হয়নি। তারা শুধু সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ব্যাপারে আলোচনা করতে চেয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে কোনো সমঝোতার চেষ্টা করেনি।’ এতে বিএনপি জামায়াত প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়া কঠিন হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে তিনটিতে আমরা প্রার্থী দিয়েছি, সেখানে জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে। আশা করছি ভালো ফলাফল পাব।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক সদস্য বলেন, ‘আমরা বিএনপিকে ছাড় দিয়েছি। তাদেরও তো আমাদের কিছুটা ছাড় দেওয়া উচিত। এ ছাড়া গত ২০১০ সালের ২২ জানুয়ারির উপজেলা নির্বাচনেও তো এককভাবেই জামায়াত সমর্থিত ৪০টির মতো চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছিল। বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে, দেখা যাক কী হয়।’
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এইউএ/কেএ/এইচএসএম/শাহ/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪)