মতিনুজ্জামান মিটু, দ্য রিপোর্ট : বছরে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকার বিষ দিয়েও দেশের ফসলে ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণ কমানো যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে কৃষকের জীবন বদলে দিতে এগিয়ে এসেছে কয়েক ধরনের বন্ধুপোকা। তাই বিষ নয় উপকারী পোকা দিয়ে ক্ষতিকারক পোকা দমনের সেই চিরায়ত কৌশলের পথে ফিরছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।

সবজিসহ বেশ কয়েকটি ফসলে বিষাক্ত কীটনাশকের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েক ধরনের উপকারী পোকা। সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন জৈব কীটনাশকের সঙ্গে ক্ষেতে উপকারী পোকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষতিকারক পোকা দমনের এ পদ্ধতি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের দেওয়া এই পদ্ধতি মোতাবেক কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে উপকারী পোকার চাষও শুরু করেছে। কৃষকরাও এ সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে উপকারী পোকা কিনে ক্ষেতে ব্যবহার করছেন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারী) কীটতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক ও প্রধান ড. সৈয়দ নূরুল আলম এ প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টকে বলেন, শস্য উৎপাদনের জন্য পৃথিবীর আদিমতম সময় থেকেই মানুষ পোকামাকড় আর রোগ বালাইয়ের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, গড়ে প্রতি বছরে শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগ খাদ্যশস্য পোকামাকড় আর রোগ বালাইয়ের আক্রমণে নষ্ট হয়।

এদের হাত থেকে মূল্যবান খাদ্যশস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ করার জন্য মানুষ অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমনের জন্য যথেচ্ছভাবে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক (কীটনাশক/ছত্রাকনাশক/কৃমিনাশক ইত্যাদি) ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিশেষত উচ্চমূল্যের সবজি যেমন বেগুন, সীম, বরবটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি ফসলে কৃষকরা মাত্রাতিরিক্ত হারে কীটনাশক ব্যবহার করে। এমনকি গ্রীষ্মকালীন বেগুন, সীম, বরবটিতে কোনো কোনো এলাকার কৃষকরা প্রায় প্রতিদিনই কীটনাশক দেন। কীটনাশক ব্যবহারের ৬ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ওই ফসল বাজারজাত করা হয়।

ড. সৈয়দ নূরুল আলম আরও বলেন, বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সহনশীল ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ওই বালাইনাশক ক্ষেতের ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগ-বালাই দমনে এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে।

বালাইনাশকের উপর্যুপরি ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যয়ও মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাচ্ছে। দেখা গেছে, বেগুন চাষীরা ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য গ্রীষ্মকালীন এক মৌসুমে প্রায় ৪০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেন। কিন্তু এত টাকা খরচ করেও পোকার আক্রমণের হার শতকরা ৪০ ভাগের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

তাই কীটনাশকের উপর একক নির্ভরশীলতা পরিত্যাগ করে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারের উপর ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কেননা এই পদ্ধতি ইতোমধ্যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, সহজে ব্যবহারযোগ্য, উৎপাদক এবং ভোক্তার জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

বারীর বিজ্ঞানীরা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী আইপিএম পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যা অত্যন্ত সস্তা ও সহজে প্রয়োগযোগ্য। আইপিএম পদ্ধতির প্রথম ধাপ হলো- পোকা আক্রান্ত ডগা ও ফল ধ্বংস করা, ২য় ধাপ হলো সেক্স ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার এবং ৩য় ধাপ হলো- উপকারী পোকা পর্যায়ক্রমিকভাবে আবাদি জমির ফসলে ছেড়ে দেওয়া।

বারীর কীটতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ম. মাহমুদুন্নবী বলেন, এক্ষেত্রে কয়েক ধরনের বন্ধু পোকা অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বর্তমানে দু’ধরনের উপকারী পোকার ব্যাপক ভিত্তিক চাষ করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে এই পোকা মুক্তায়িত (ফসলের ক্ষেতে উপকারী পোকা ছেড়ে দেওয়া) করায় সফলতাও এসেছে।

তিনি বলেন, এ দু’ধরনের উপকারী পোকার একটি হলো অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতি (এক ইঞ্চির ১০০ ভাগের এক ভাগের সমপরিমাণ) বোলতা জাতীয় পোকা। যার নাম ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ। এটি ক্ষতিকারক বিশেষ করে মথ বা মাজরা জাতীয় পোকার ডিম নষ্টকারী পোকা হিসেবে পরিচিত। অন্যটি হলো ব্রাকন হেবিটর। যা ক্ষতিকারক মথ বা মাজরা জাতীয় পোকার কীড়া নষ্টকারী পোকা হিসেবে পরিচিত।

প্রতি সপ্তাহে একবার করে ডিম নষ্টকারী পরজীবী পোকা অর্থাৎ ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ (হেক্টরপ্রতি এক গ্রাম পরজীবী পোকা আক্রান্ত ডিম, যেখান হতে ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার পূর্ণাঙ্গ ট্রাইকোগ্রামা বের হয়ে আসবে) ও কীড়া নষ্টকারী পরজীবী পোকা ব্রাকন হেবিটর (হেক্টরপ্রতি এক বাংকার বা ৮০০ থেকে ১২০০টি পূর্ণাঙ্গ পোকা) পর্যায়ক্রমিকভাবে মুক্তায়িত করতে হবে।

ওই উপকারী পোকা কেবল বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকাই নষ্ট করে না, এ জাতীয় প্রায় ২০০টির মতো শত্রু পোকার ডিম বা কীড়া ধ্বংস করতে পারে। যেমন কুমড়া জাতীয় ফসলে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে মাছি পোকা যা ফেরোমন ফাঁদ পেতে দমন করা সম্ভব হচ্ছে।

মাছি পোকা ছাড়াও বেশ কয়েক ধরনের মাজরা জাতীয় পোকা এদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। বিশেষত স্পোডেপটরা লিটুরা, পামকিন ক্যাটারপিলার করলা, কাকরল, উচ্ছে ইত্যাদি ফলে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। এতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ফসলের ক্ষতি হয়।

এসব পোকা কীটনাশক ব্যবহারে দমন করা অত্যন্ত দুরূহ। ডিম নষ্টকারী পরজীবী পোকা অর্থাৎ ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ ও কীড়া নষ্টকারী পরজীবী পোকা অর্থাৎ ব্রাকন হেবিটর এ ধরনের পোকা দমনে অত্যন্ত কার্যকর। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক সপ্তাহ পর পর ওইসব বন্ধুপোকা জমিতে প্রয়োগ করলে ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণের হার শতকরা ৫ ভাগ নিচে নেমে আসে।

এক মৌসুমে বিশেষত গ্রীষ্মকালীন বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য কোনো কোনো অঞ্চলের বেগুন চাষীদের হেক্টরে ৬০ হাজার টাকা দামের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। অথচ সেখানে আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা।

অর্থাৎ বর্তমান খরচের এক-চতুর্থাংশেরও কম খরচে প্রায় দ্বিগুণ ভালো বেগুনের ফলন পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে করলার জমিতে আইপিএম পদ্ধতি আরোপ করে কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহারের চেয়ে হেক্টর প্রতি ৪ দশমিক ২৫ গুণ কম খরচ করে প্রায় দ্বিগুণ টাকা আয় করছে।

আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারে মিষ্টি কুমড়ার পোকা আক্রান্তের হার কীটনাশকের ব্যবহারের চেয়ে প্রায় ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ গুণ কম হয়। ফলনও সে অনুপাতে বাড়ছে। এতে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ গুণ বেশি টাকা আয় করতে সক্ষম হচ্ছেন কৃষকরা। রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না বলে উদ্ভাবিত আইপিএম পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যগত সমস্যামুক্ত।

কয়েক প্রজাতির পাতাখেকো পোকা বাঁধাকপি ও ফুলকপি ফসল নষ্ট করে ফেলে। এদের মধ্যে ডাইমন্ড ব্যাক মথ ও স্পোডপটেরা পোকা সবচেয়ে ক্ষতিকারক। এদের আক্রমণে ক্ষেত্র বিশেষে শতকরা ৬৫ ভাগ পর্যন্ত ফসল নষ্ট হতে পারে। কৃষকরা ওই পোকা দমনে উপর্যুপরি কীটনাশক ছিটিয়েও ভাল ফল পায় না।

হাত বাছাই ও উপকারী পোকা মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার করে এই ক্ষতিকর পোকা সফলভাবে দমন করা সম্ভব। পাতাখেকো পোকার আক্রমণের প্রথমাবস্থায় আক্রান্ত পাতার পোকাগুলি হাতবাছাই করে মেরে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে বন্ধু পোকা (ডিম নষ্টকারী পরজীবী পোকা- ট্রাইকোগ্রামা ও কীড়া নষ্টকারী পরজীবী পোকা- ব্রাকন) এক সপ্তাহ পর পর মাঠ পর্যায়ে মুক্তায়িত করতে হবে।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলভাবে পাতাখেকো পোকা দমন করা সম্ভব। এতে কীটনাশক ব্যবহারের তুলনায় শতকরা প্রায় ৬৬ দশমিক ৬ ভাগ বেশি ফলন লাভ এবং প্রায় ৩০ ভাগ বেশি টাকাও আয় করা সম্ভব। এমনিভাবে সীম, বরবটি, ঢেঁড়শসহ বেশ কয়েকটি সবজি ফসলের ক্ষতিকারক পোকা দমনে বন্ধু পোকার দল বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।

ধান ক্ষেতে বর্তমানে বাদামি ঘাসফড়িং এর আক্রমণের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। বাদামি ঘাসফড়িং সাধারণত বন্ধু পোকা দিয়েই দমন করা সম্ভব। জমিতে কীটনাশকের উপরি ব্যবহার বন্ধ ও উপকারী পোকা মিরিটি বাগ মুক্তায়িত করে ওই ঘাসফড়িং এর আক্রমণ রোধ করা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

রাসায়নিক কীটনাশকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর ব্যাপক ব্যবহারে উপকারী পোকামাকড় বিলুপ্ত হওয়া। অথচ এই উপকারী পোকামাকড় হতে পারে কৃষক ভাইদের সবচেয়ে বড় সহায়ক।

গবেষণায় দেখা গেছে ধানের জমিতে ক্ষতিকারক পোকার পরিমাণ মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ। অন্যদিকে সবজির জমিতে এদের সংখ্যা মাত্র ২৩ ভাগ। এই হিসেবে বলাই যায়, মাত্র ২০ ভাগ ক্ষতিকারক পোকা দমনের জন্য যে বিষ প্রয়োগ করা হয় তাতে প্রায় ৮০ ভাগ বন্ধু পোকাও ধ্বংস হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে ড. সৈয়দ নূরুল আলম বলেন, আমাদের দেশে বছরে প্রায় বারো শত কোটি টাকার বিষ ব্যবহার করেও ২০ ভাগ ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষাক্ত কীটনাশকমুক্ত আইপিএম পদ্ধতি দেশের সর্বত্র চালু করা গেলে উৎপাদন খরচ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এইচএসএম/এএইচ/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪ )