বেনাপোল সংবাদদাতা : যশোরের চৌগাছায় পিকনিকের বাস উল্টে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় শোকের মাতম চলছে গোটা এলাকায়। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের চোখের পানিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় নিহতদের বাড়িতে। রবিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নিহতদের এক নজর দেখার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমাবেত হন। হাজারো মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানান সাত সোনামুখকে। আহাজারি আর নানা স্মৃতির কথা বলতে বলতে অনেক স্বজন ডুকরে কাঁদছেন। শুধু স্বজন কিংবা সহপাঠীদের আর্তনাদ নয়, শিক্ষক, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমবেদনায় ভারি হয়ে ওঠে সমগ্র এলাকায়।

নিহতদের রবিবার দুপুরে বেনাপোল ফুটবল মাঠে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ দুই দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মৃতদেহ দাফন করা হয়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেন জানাজায়। জানাজায় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা পরিচালনা করেন বেনাপোল-গাজীপুর জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মজিদ।

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিনা ইয়াসমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে নিহতের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানাতে ছুটে যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। নিহতদের স্মরণে শার্শা উপজেলায় একদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেনাপোল পৌরসভার পক্ষ থেকে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।

রবিবার সরেজমিনে নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো এলাকার মানুষ যেন গুমরে কাঁদছে। সমবেদনা জানানোর কোনো ভাষা নেই কারও। প্রতিটি মৃত্যুই মানুষকে নাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে মর্মন্তুদ দুই বোনের মৃত্যু। মা হারা দুই শিশুর অকাল মৃত্যুতে বাবা সৈয়দ আলী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী বড় মেয়ে সুরাইয়া খাতুন (১০) ও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছোট মেয়ে জেবা খাতুনের (৮) মৃতদেহের পাশেই নির্বাক তিনি। আড়াই বছর আগে স্ত্রী মনোয়ারা খাতুনকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর থেকেই মেয়ে দুটি নানাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত।

বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর মতো আরও পাঁচ নিহত শিক্ষার্থীর পরিবার আদরের সোনামণিদের হারিয়ে কেউ বাকরুদ্ধ আবার কেউ কেউ মূর্ছা যাচ্ছেন বার বার। পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা।

পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মিথিলার (১০) বাবা ছোট আঁচড়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনুস আলী জানান, তাদের তিন ভাইয়ের দুই মেয়ে। সবার চোখের মণি ছিল মিথিলা। তাকে সবাই চোখে চোখে রাখত। সেই মেয়ে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল। শুধু সুরাইয়া, জেবা কিংবা মিথিলার পরিবার নয়, নিহত সাত পরিবারের সদস্যরা স্বজনদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

নিহতরা হল- বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া (১০) ও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী জেবা আক্তার (৮), ছোট আঁচড়া গ্রামের ইউনুস আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মিথিলা (১০), রফিকুল ইসলামের মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী রুনা আক্তার মীম (৯), লোকমান হোসেনের ছেলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শান্ত (৯), গাজীপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সাব্বির হোসেন (১০), নামাজ গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি (১১)।

নিহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে বাড়িতে ছুটে যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ, জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একেএম আরিফুল হক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সুব্রত কুমার বণিক, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মিন্নু, বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফুল আলম, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অহিদুল ইসাম প্রমুখ।

(দ্য রিপোর্ট/জেএইচ/এএস/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪)