গল্প, উপন্যাস এবং টিভি নাটক চর্চায় মগ্ন মনি হায়দার। এ পর্যন্ত তার গ্রন্থ সংখ্যা ৫৫টি। এবারের মেলায় তার ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কথা প্রকাশ থেকে বেরিয়েছে তেরোটি গল্প নিয়ে গল্পগ্রন্থ ‘ঘাসকন্যা’| শোভা প্রকাশ থেকে এসেছে শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘ট্রেন তোমার বাড়ি কোথায়, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, নলেজ ভিউ প্রকাশ করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প’, নান্দনিক রোমান্টিক উপন্যাস ‘মন নাগর’ তার প্রকাশিত গ্রন্থ এবং ব্যক্তিগত চিন্তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য রিপোর্ট-এর প্রতিবেদক মুহম্মদ আকবর।

সমকালের কথাসাহিত্য সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

মনিহায়দার : আমার সমকালে অনেক ভালো ভালো গল্প লেখা হয়েছে। অনেক মেধাবী গল্পকার এসেছেন। তারা নিজস্ব চিন্তা, আখ্যান চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের গল্পে। মানুষের জীবন গল্পেরই জীবন। আমি বিশ্বাস করি একদিন সারা পৃথিবী হবে গল্পের পৃথিবী। কারণ, মানুষের জীবন তো গল্প ছাড়া হয় না। সংসার, সভ্যতা তো গল্প ছাড়া চিন্তাই করা যায় না।

গল্প, উপন্যাস, নাটক গদ্যের তিনটি শাখায় লিখছেন কিন্তু কোন শাখায় লিখতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

মনি হায়দার : অবশ্যই ছোট গল্প লিখতে আমি বেশি অনুপ্রাণিতবোধ করি। আমার মনে হয়, লিখিত শিল্পের যতগুলো প্রকরণ রয়েছে, তার মধ্যে ছোট গল্প সবচেয়ে মহার্ঘ্য। শিল্পের সুকুমার কলা সমৃদ্ধ। আঙ্গিকে ছোট কিন্তু অনুভবে বিশাল। একটি ছোট গল্প একজন পাঠককে খুন করতে পারে, রক্তাক্ত করতে পারে, উজ্জীবিত করতে পারে। বিরহে দিতে পারে মিলনের ঐশ্বর্য, প্রেমে দিতে পারে অনুরণন। ছোট গল্প দিতে পারে বিপ্লবের দীক্ষা। সে কারণে নানা অনুরণন থাকলেও ফিরে ফিরে আসি ছোট গল্পের নান্দনিক কারখানায়।

দীর্ঘ বিশ বছরের লেখালেখিতে এ পর্যন্ত আমার দশটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই মেলায় এসেছে ‘ঘাসকন্যা’। হিসেব করে দেখেছি-প্রায় দুইশত গল্প আমি লিখেছি| জানি- ছোট গল্পের পাঠক সব সময়ই কম। কারণ–ছোট গল্প পাঠ করে সুখ পেতে হলে চেতনার গভীরে থাকা দরকার শিল্পের সুষমা। সেই সুষমামণ্ডিত পাঠক বিশেষ করে ছোট গল্পের জন্য সব সময়েই কম। তারপরও নানা প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে ছোট গল্প এগিয়ে চলেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে। বিশ্বাস করি- একদিন পৃথিবী হবে ছোট গল্পের পৃথিবী।

আপনার লেখার স্বাতন্ত্র্য কোথায়?

মনি হায়দার : আমার গল্পে, উপন্যাসে এমন কী নাটকে যেটা আনার চেষ্টা করি তা হলো মানুষের অন্তর্জমিন। প্রতিদিন আমরা কত মানুষ দেখি হাসছে, উল্লাসে নৃত্য করছে। কিন্তু আসলে ঐ মানুষটি কী সুখি? সুখ বাক কী? আমার গল্পের আখ্যানে মানুষের মনের গভীরের চিন্তা, বেদনা, সুখ, অসুখ প্রতিশোধ স্পৃহা, পরকীয়া তথা অনাবিষ্কৃত কদর্য, সৌন্দর্য এবং অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ তীব্রভাবে আমার লেখায় স্বাতন্ত্র্যতা অর্জন করেছে।

লেখক হিসেবে দায়বদ্ধতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মনি হায়দার : দায়বদ্ধতা ছাড়া মানুষ হয় না। মানুষ মাত্রই দায়বদ্ধ, নিজের কাছে-সমাজের কাছে। আর একজন গল্পকার হিসেবে তো, দায় আরও বেশি। কারণ আমি যে গল্পটি লিখছি উপন্যাস অথবা নাটক-সেটা তো মানুষের কাছে যাচ্ছে। আর মানুষইতো আমার সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। মানুষ আছে বলেই আমি আছি। আমি মনে করি-দায়হীন মানুষ মানুষ না প্রাণিমাত্র।

সুতরাং আমি আমার গল্পে, গল্পের চরিত্রে, আখ্যান সব সময় সুন্দর ও নম্রতার প্রসঙ্গ আনি। যে কোনো গল্পের মধ্যে থাকে সুন্দরের অন্তর্নিহিত সুখের পরম নির্যাস। গল্প যারা পাঠ করেন, তারা মননে সৃজনে অন্যদের থেকে আলাদা। সেই আলাদা মানুষের মননের জায়গা স্পর্শ করতে হলে গল্পকারকে অনেক দায়বদ্ধ হতে হয়। আমি সেই দায় নিই এবং যতদিন বেঁচে আছি গল্পে, গল্পের আখ্যানে ততদিন নেব।

সাহিত্যাঙ্গনে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের লেখকদের উপস্থিত নিশ্চিত করতে প্রকাশকদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?

মনি হায়দার : শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো-প্রকাশক একজন ব্যবসায়ী। তারা সাহিত্যের সওদা ফেরি করতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেননি। আমি প্রকাশকদের পক্ষে কথা বলছি না। বলছি সামগ্রিক প্রসঙ্গ। দেশের প্রান্তিক লেখকদের জন্য যদি কিছু করার থাকে, করতে পারে সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিংবা প্রান্তিক লেখকদের প্রসঙ্গ বিবেচনা করে সরকার ভিন্ন কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে। সেখানে প্রকাশকদের সংযুক্ত করা যেতে পারে। ভেবে দেখুন- বাংলাদেশে প্রায় বিশ কোটি মানুষ। কিন্তু পাঠ করছে কত জনে? যারাই বা পাঠ করেছেন-তারা বই পাঠ করছেন? গত কয়েক বছরে সৃষ্ট বইয়ের বাজার একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে আছে। বলা যায়-বাংলা সাহিত্য একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে আছে। এই আটক গণ্ডি থেকে বের করতে হলে কেবল প্রকাশক নয়, দেশের মানুষ-পাঠকদের সচেতন হওয়া জরুরি। সব প্রকাশক খারাপ তাও বলতে চাই না। অনেক প্রকাশক আছেন তারা কেবল ব্যবসা নয়, সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসেন। চান ভিন্ন আঙ্গিকে কিছু করতে। কিন্তু তাদের সাধ্য সীমিত। সেই সীমিত সাধ্যের সঙ্গে যদি আমাদের মনন ও মনীষা মিলিত হতে পারত-আমাদের প্রকাশনা শিল্প অনেক দূর এগোতে পারত।

এবারের গ্রন্থমেলা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

মনি হায়দার : আমি বলব বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবার সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি মেলাকে বাংলা একাডেমির সীমিত পরিসর থেকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে অমর একুশের বইমেলাকে মুক্তি দিয়েছেন। অনেকে বলে থাকেন, বইমেলায় প্রাণ নেই। আসলে প্রাণ তার নিজের নেই। কিছু লোক আছে বিকল্প কিছু দেখলেই আঁতকে ওঠে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধ সীমাকে পেছনে ফেলে বিকল্প চিন্তা করার সময় এসেছে। ঢাকা শহরে বাস করে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। তাদের প্রতিদিন নানা রকমের চাহিদা বাড়ছে। বাড়ছে সংস্কৃতির বিকাশ। সেই বিকাশের মাত্রা বেড়েছে, পাঠক বেড়েছে, লেখা ও লেখকও বেড়েছে। ফলে মেলা বাংলা একাডেমির সীমিত পরিসরে আটকে গিয়েছিল। মানুষ দম নিতে পারত না। এখন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল আয়োজনে বইমেলা হওয়ায় পাঠক, লেখক ও প্রকাশক মিলে এক আনন্দঘন মেলার যাত্রা শুরু হয়েছে। যা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। করেছে আন্দোলিত।

(দ্য রিপোর্ট/এমএ/এপি/এএল/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪)