কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট: দীর্ঘ ১১ মাস ইরাকে এক কোম্পানির ক্যাম্পে বন্দি জীবন শেষে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশি ১১ শ্রমিক। অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে (ফ্লাইট নং-৯৫১৫) সোমবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে তারা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।

এদিকে বাকি দুই শ্রমিক ইরাকের নাজাফ বিমানবন্দরেই আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছেন ফেরত আসা শ্রমিকরা। বিমানবন্দরে এ সময় ফেরত আসা শ্রমিকদের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে রবিবার রাতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মহসিন উদ্দিন চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছিলেন, সোমবার সকাল ১০টার মধ্যেই ১৩ জন শ্রমিক দেশে ফিরছেন।

ইরাক ফেরত ১১ শ্রমিক হলেন-টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শফিকুল ইসলাম, একই জেলার সখিপুর উপজেলার হুমায়ুন, ঘাটাইলের মোশাররফ, ইউসুফ মিয়া, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার রুবেল মাহমুদ, ফরিদুপরের সদরপুর উপজেলার সাইদুল ইসলাম ও ইলিয়াস, নওগাঁ জেলার আতরাই উপজেলার কাশেম আলী, মান্দা থানার মো. আজাদ, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের শ্যামল দাস ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আব্দুর রহিম।

বিমান থেকে নামার পর শাহজালাল বিমানবন্দরে থাকা অবস্থায়ই এই প্রতিবেদকের কথা হয় হতভাগ্য শ্রমিকের সঙ্গে। এ সময় তারা ১১ মাসের বন্দি জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতি তুলে ধরে কেঁদে ফেলেন। আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন তাদের স্বজনরাও।

ইরাক ফেরত টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মোশাররফ দ্য রিপোর্টকে জানান, ‘দীর্ঘ ১১ মাস ওখানে বন্দি ছিলাম। কি অবস্থায় যে ছিলাম রে ভাই তা বুঝাতে পারব না। আল্লাহ যে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন এটাই শুকরিয়া।’

তিনি বলেন, ‘১১ মাসে কোনো বেতন-ভাতা দেয়নি। খাবারও ঠিকমতো দেয়নি। ফেব্রুয়ারির ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত তিনদির আমরা না খেয়ে থেকেছি।বেতনের কথা বললেই অমানুষিক নির্যাতন করতো। সামনে যা পেত মালিক ও তার লোকজন তা দিয়েই পেটাতো।’

মোশাররফ আরো বলেন,‘দীর্ঘ ১১ মাসে অ্যামবেসি থেকে রুহুল সাব আর জেহাদ সাব (দূতাবাস কর্মকর্তা) আমাদের কাছে গিয়েছিলেন। এছাড়া আর কেউ আমাদের খোঁজ নেননি। তারা যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করার পর যখন চলে এসেছেন তখন আমাদের ওপর নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মালিক।’

তিনি বলেন, ‘আমরা রুহুল সাব ও জেহাদ সাবকে বললাম,স্যার আমরা আর এভাবে কতদিন নির্যাতন সহ্য করব। আমাদের বাঁচান। আমাদের তো কোনো বেতন ভাতা দিল না। কমপক্ষে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। উত্তরে তারা বলেছেন, তোমরা অবৈধভাবে এসেছো, কি করব বলো।’

মোশাররফ আরও বলেন, ‘মালিক আলী হায়দার একদিন বললেন, তোমাদের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আগামী ৯ তারিখ(ফেব্রুয়ারি) তোমাদের ফ্লাইট। আমরা আশায় বুক বেঁধে ছিলাম, ৯ তারিখে আমরা বাড়ি যেতে পারব। কিন্তু ওই দিন সকালে মালিক এসে বললেন,তোমাদের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গতকাল (রবিবার) মালিক আলী হায়দার বললেন তোমাদের আজ বিকেলে ফ্লাইট। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমাদের ১৩ জনকে নাজাফ ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়েই তিনি চলে গেলেন। আমরা আবারও বিপদে পড়লাম। পরে ফরিপুরের এক লোকের কাছ থেকে চার হাজার ডলার ঋণ নিলাম। ৫০০ ডলার করে বিমানবন্দরে জরিমান দিয়ে কোনোমতে চলে এলাম। তাও আবার দুইজনকে রেখেই।’

দুইজনকে রেখে কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিক নাকি তাদের বাদ দিয়েই ভিসা করেছিল। ওরা এখন ওখানেই আছে।

নাজাফ ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে থেকে যাওয়া দুজন হলেন-কুষ্টিয়ার আব্দুল মালেক ও নরসিংদীর রবিউল।

ইরাক ফেরত ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই কিভাবে যে দিন কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। টাকা পয়সা তো দেয়ই নি। ঠিকমতো খেতেও দেয়নি তারা। আমাদের জন্য ভিসা ও টিকিট করার পর মালিক একটা কাগজে জোর করে স্বাক্ষর নিয়েছে। স্বাক্ষর দিতে না চাইলে বেধরক মারধর করেছে।’

তিনি বলেন, ‘অলিউল্লাহ হলো ওই মালিকের খাস লোক। তিনি বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের দায়িত্বে আছেন। তার উপস্থিতিতেই মালিক আমাদের যখন তখন মেরেছে। অলিউল্লাহ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কোনো কিছুই বলেনি।’

সাইদুল বলেন, ‘মরুভূমির মধ্যে টিনের ঘর তুলে সেখানে আমাদের ২৭ জনকে রাখতো। এর আগে ১১ জন দেশে ফেরার পর, সেখানে শুধু আমরাই থাকতাম।’

সাইদুল আরো বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যারা প্রতারণা করেছে তাদের কঠোর শাস্তি চাই। আমাদের বেতন-ভাতা চাই। সরকারকে বলবো, তারা যেন আমাদের ক্ষতিপূরণ ও কর্সংস্থানের ব্যবস্থা করে।’

ইরাক ফেরত মোশাররফের ছোট ভাই আবু হানিফ বলেন, ‘১১ মাস আমাদের যে কিভাবে কেটেছে তা বলে বোঝাতে পারব না। মাঝে মাঝে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হতো আমাদের। আমরা মন্ত্রণালয়ে বারবার যোগাযোগ করেছি তাদের ফিরিয়ে আনতে। এতদিন পরে যে ভাইকে পেয়েছি, এটা ভাবেই ভাল লাগছে। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া।’

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে মেসার্স মর্নিং সান এন্টারপ্রাইজ (আরএল-৮৪৫), মেসার্স মেঘনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৫৫), মেসার্স ইস্ট বেঙ্গল ওভারসিজ (আরএল-৯১২) ও মেসার্স আইডিয়া ইন্টারন্যাশনাল লি.(আর এল-৯৫৩) নামে চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ২৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিক ইরাকে যান। মাসে তাদের ৩৫০ ইউএস ডলার বেতন দেওয়া হবে এই শর্তে কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিজনের কাছ থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

ইরাকের না আবু তরুফ নামক স্থানে মরুভূমির মধ্যে এম কোদিয়া জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির ক্যাম্পে দীর্ঘ ১১ মাস বন্দি জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় এসব শ্রমিকরা। এর আগে সেখানে দীর্ঘ ৮ মাস মানবেতর জীবনযাপন করার পর গত ৩০ নভেম্বর ১১ জন শ্রমিক দেশে আসতে সক্ষম হলেও বাকিরা সেখানেই রয়ে যান।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/ কেএন/ ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪)