আরিফ সোহেল, দ্য রিপোর্ট : টানা ৩ দিনই বলা যায় থেকে থেকে বৃষ্টি। সোমবার সকালেও বেশ বৃষ্টির রেশ। মিরপুরে ম্যাচ হবে কী হবে না; এই আশঙ্কায় যখন কাকভিজা অভ্যাগতরা। তখন আম্পায়াররা জানিয়েছেন শুভ-সংবাদ। ম্যাচ হচ্ছে। তবে কার্টেল ওভারে; ৪৩-এ। এমন এক ম্যাচ বোলারদের বারুদে স্পেলে ফাগুনের সিগ্ধতায় পুলকিত হয়েছেন সূচনাতেই ক্রিকেটপ্রেমীরা। টস জয়ের মৌ মৌ সৌরভ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে বোলাররা একটুও সময় নেননি। বরং কত দ্রুতপ্রস্থান নিশ্চিত করা যায় প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যা্নদের; সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। বোলিং তোপের মুখে কার্টেল ওভার শেষ না করেই শ্রীলঙ্কা ১৮০ রানে অল আউট হয়েছে। বৃষ্টি মাথায় যারা এসে দুপুরেও বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করছিলেন; বোলারদের এমন কিছু দেখে তাদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা-উৎফুল্লতা মিষ্টির রোদের আকাশ ছুঁয়েছে। এক কথায় তৈরি হয়েছিল আনন্দমঞ্চ।

যে আনন্দের উদ্বেলতায় বোলাররা ভাসিয়েছেন; সেখানেই শ্মশানের নীরবতা নেমে এসেছে ব্যাটিং সেশনে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৮১ রানের টার্গেটও তখন মনে হয়েছে অ-নে-ক বড়। অথচ দারুণ শুরু; তারপরও দারুণ। কিন্তু বাজে কিছু শটস; সঙ্গে আরেকটি আফসোসের পরাজয়ের কলঙ্ক টীকা। বাংলাদেশের শামসুর-মুশিফিকরা এর চেয়ে সহজ সুযোগ কী পাবে। হেলাফেলায় ৩ ওয়ানডে সিরিজে এগিয়ে থাকাও হল না। হল না সাগরিকায় জিততে জিততে হেরে যাওয়া ম্যাচের কষ্টগাথাকে জয়ের আলোতে আলোকিত করার। বৃষ্টি ভেজা উইকেটে বোলিং নিয়ে যে ফায়দা নিয়েছে বাংলাদেশ; ঠিক রাতের শীতের শিশিরের সঙ্গে তা সুদে-আসলে ফেরত দিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। সন্ধ্যা অবদি আনন্দ ফল্গুধারা রাতে অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। ১৮১ রানের জবাবে ১৬৭ রানেই অল আউট; হার ১৩ রানের। এবং সিরিজে পিছিয়ে থাকাও যুক্ত হয়েছে।

জবাব দিতে ওভারপ্রতি রান ছিল মাত্র ৪.২০৯। দেখে শুনে খেললেই হবে। অথচ তাতেই কী বিপদের ছায়া! মালিঙ্গার দ্বিতীয় বলেই এনামুলের পটপাট বিদায়। কিন্তু পরের জুটিতে দারুণ জবাব। রানের নামতা পড়তে পড়তে শামসুর-মুমিনুল দারুণ শুরু করেছেন।

দ্বিতীয় উইকেটে দারুণ পারফর্ম করেছেন মুমিনুল হক। ঠিক সাগরিকার মতোই জয়ের অভিযাত্রায় মন-ধ্যান দিয়ে ব্যাটিং করেছেন। কিন্তু থিসারা পেরেরার একটি বল ফাঁকি দিয়েছে তাকে। মুমিনুল ৪৪রানে থেকে পয়েন্টে তালুবন্দী হয়েছেন দিলশানের হাতে।তিনি ফিরে যাওয়ার পরও উইকেটে দারুণ খেলেছেন শামসুর। সঙ্গী পেয়েছেন অধিনায়ক মুশফিককে। তার ৩টি দৃষ্টিনন্দন ছক্কায় আরো উচ্ছ্বাস বাড়িয়েছে গ্যালারিতে। কিন্তু শামসুর রহমান ৬২ দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানআউট হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন। তার আউটটি নিয়ে একটু কিন্তু থাকছে। সেই কষ্ট আরো বেড়েছে সাকিবের রান আউট দেখে। আবারো প্রয়োজনীয় সময়ে ব্যর্থ হয়েছেন সাকিব আল হাসান (৩)। সেনানায়কের নির্ভরতার প্রতীক নাসির হোসেন (৮)ও মাহমুদউল্লাহ (০) দ্রুত ফিরে গেলে চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। সেই চাপ নিয়েই অধিনায়ক মুশফিককে লড়াই করতে হয়েছে। ব্যক্তিগত ২৭ রানে ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলতে গিয়ে সাঙ্গাকারার হাতে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি। আর গুটিয়ে যাওয়ার আগে ১৬৭ রান করেছে বাংলাদেশ।

হিসেবটা এমন; ১ রানে এনামুল চলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় উইকেটে মুমিনুল-শামসুর যুগলবন্দি থেকেছেন দলীয় ৭৯ রান পর্যন্ত। তৃতীয় উইকেট জুটিতে শামসুর-মুশফিক তুলেছেন ৩৫। তারপর থেকেই আসা-যাওয়ার মিছিল। শেষ সম্ভাবনার বাতি জ্বালিয়েছেন মুশফিক-সানিকে নিয়ে। তারা অষ্টম উইকেটে ১৯ রান করে নতুন করে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করেছেন। ১৬১ রানে সানি চলে যাওয়ার পরও স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছেন মুশফিক। কিন্তু দলীয় ১৬২ রানের মাথায় একটি অপ্রত্যাশিত স্কু শট খেলে ক্যাচ দিয়েছেন সাঙ্গাকারার হাতে। তখন তার নামের পাশে ছিল ২৭ রানের একটি ব্যর্থময় স্কোর। কারণ মুশফিক মাটি কামড়ে ব্যাটিং করলেও ওখান থেকেও ম্যাচ বাঁচাতে পারতেন।

এর চেয়ে দূরন্ত শুরুর সুযোগ ছিল না বাংলাদেশের। ওভারে ওভারে উইকেট তুলে নিয়ে আশঙ্কার মহাকালে ফেলে দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। এই ম্যাচেও দিলশান ব্যাটে ছন্দ খুঁজে পাওয়ার আগেই বিদায় করে দিয়েছেন পেসার রুবেল। তার শর্ট ডেলেভারিতেই বোকা বনেছেন দিলশান। পুল করার চেষ্টা করেছিলেন; ব্যাট বলের সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারেনি। মিস টাইমিংয়ের বলটি মুশফিকের হাতবন্দি হয়েছে মিডউইকেটে। ২২/১; এই যখন পরিস্থিতি সেখানে ইনফর্ম কৌশল পেরেরাও ব্যর্থ। এবার উইকেট টেকার রুবেল। তার ফুলটসের সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন লেগ সাইডে বল ঘুড়িয়ে। কিন্তু যথাযথ হয়নি। কারণ বলটি ছিল উইকেট সীমানায়। লেগেছিল পায়ে। আবেদন এবং আউট। ২৮ রানে শ্রীলঙ্কা ২ উইকেট হারিয়ে টস হারের মাশুল গুনছিল। প্রথম স্পেলেই রুবেল তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব দারুণভাবে পালন করেছেন। এবার অভিসিক্ত আল-আমিনের পালা। তিনি তার প্রথম স্পেলে বেছে নিয়েছেন শ্রীলঙ্কান সেরা ব্যাটসম্যান সাঙ্গাকারাকে। বাংলাদেশকে ভয় পা্ইয়ে দেয়ার আগেই সাঙ্গাকারাকে বিদায় করেছেন আমিন। তখন মাত্র ৮ রানে ব্যাটিংয়ে ওই ভয়ানক সাঙ্গাকারা। সাকিবে মাত্র বলহাতে শুরু করেই বিদায় করেছেন প্রিয়াঞ্জানকে। দিনেশ চান্দিমালের উইকেট পড়েছে রানআউটের খড়গে পড়ে। কাভার পয়েন্ট থেকে অভিসিক্ত সানির থ্রো থেকেই আল বিদা চান্দিমালের। এবার অধিনায়ক ম্যাথুসকে সানি নিজেই পাঠিয়েছেন বোল্ড করে। পরের উইকেট সানির; টার্গেট ব্যাটার ভিথানেজে। অভিষেকের ম্যাচে প্রথম স্পেলে ২ উইকেট তুলে নিয়েছেন সানি। এভাবে ৬৭ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে যখন ধুকতে বসেছে শ্রীলঙ্কা; ঠিক তখনই উইকেটে শতভাগ থিতু হয়ে গেছেন পেরেরা-সেনানায়েকে; পেরেরা-মালিঙ্গা জুটি। আসলে ওই জুটিদ্বয়ের রানই বাংলাদেশকে বিজয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত যা করেছে; তাতে বাকরুদ্ধ হয়েছেন ক্রিকেটভক্তরা।

বৃহস্পতিবার শ্রীলঙ্কান ইনিংসে নবম উইকেটে পেরেরা-সেনানায়েকের ৮২ রানের জুটি দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছে।। আর দশমে পেররা-ম্যালিঙ্গার ৩১ রান দলকে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার ১৮০ রান থেকে ওই যুগল রানের যোগফল ছেটে ফেললে দাঁড়ায় ৬৭ রান। ঠিক ওই রানে শ্রীলঙ্কান সব ‘আসল’ ব্যাটসম্যানের বিদায়। তিসারা পেরেরা আগের ম্যাচেও বাংলাদেশকে ভুগিয়েছে; হারিয়েছে। সোমবার ব্যাটিংয়ে আবারও সেই রণমুর্তি। এর আগে ২ হাফসেঞ্চুরি থাকলেও বোলার হিসেবেই পেরেরার দলে জায়গা পাওয়া। সাগরিকার পর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শেরে বাংলাও তার দুর্দান্ত ব্যাটিং বিমোহিত স্টোকে সৌরভময় ছিল। বাঙালি ক্রিকেট ভক্তদের বারুদে আনন্দ হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়েছেন ওই পেরেরা। ৬৮তম ম্যাচে এটা তার ক্যারিয়ার সেরা রান। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার ৬৫ ও ৬৯* রান ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে বোলার হলেও সেনানায়েকের ব্যাটে আগেও ৪২ রানের ইনিংস ছিল। এমনকি তার গড় রান ১৯। ৩০ রানের সেনানায়েকের ইনিংসটি তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা। মালিঙ্গা স্লিপে ক্যাচ তুলে দিয়েও বেঁচে গেছেন। বেঁচে গেলেন বাউন্ডারি সীমানায় পেরেরাও। ওই ২ ফসকে যাওয়া ক্যাচেই ফসকে গেছে প্রথম ম্যাচ।

না, এটা শ্রীলঙ্কার পার্টনারশিপ বিবেচনায় সর্বোচ্চ কোনো রানের ইংনিংস নয়। এর আগে ২০১০ সালে ম্যাথুস-ম্যালিঙ্গা নবম উইকেট অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩২ রানের রেকর্ড গড়েছেন। অন্যদিকে রাসেল আরনল্ড-সিভলা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে শেষ জুটিতক রান তুলেছেন ৫১।

ওয়ানডে সিরিজের শুরুটা দারুণভাব্ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আসলে হাত ফসকে গেছে একবার বাউন্ডারিতে; অন্যবার স্লিপে। শেষ ২ জুটিতে শ্রীলঙ্কান ওই রান বাংলাদেশের ক্যাচ মিসের কল্যাণেই। সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে সফরকারীরা বুধবার দ্বিতীয় ম্যাচে নামবে ফুরফুরে মেজাজে।

সংক্ষিপ্তস্কোর

শ্রীলঙ্কা:১৮০/১০(থিসারা৮০*,সেনানায়েকে৩০,কৌশল২০;সাকিব২/২৯,আরাফত সানি২/৩১,রুবেল২/৩৭)।

বাংলাদেশ:১৬৭/১০(শামসুর৬২,মুমিনুল৪৪,মুশফিক২৭;ম্যাথুস৩/২১)।

ফল : শ্রীলঙ্কা ১৩ রানে জয়ী।

(দ্য রিপোর্ট/এএস/সিজি/এমএ/ওআইসি/ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪)