মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদের উপন্যাস–বৃদ্ধাশ্রম (পর্ব ৩)
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ছে রেহেনা। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে। মনে হচ্ছে ভালো ঘুম হবে। এখানে আসার পর থেকে তার ঘুম কোথায় চলে গেছে! অথচ এখানে আসার আগে বড় ঘুম কাতর ছিলো রেহেনা।ছোট বেলা থেকে বিছানায় গেলেই ঘুম পেয়ে বসত তাকে। এক ঘুমে রাত পার।এ নিয়ে ছোট মামী তাকে কতো বকাবকি করেছে। ছেলে বেলার কথা মনে পড়ে রেহেনার। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর তার ঠাঁই হয় মামা বাড়িতে। মামাদের একান্নবতী পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। নানা-নানী, মামা-মামী, মামাত ভাই-বোন, বাড়ির কাজের লোক। সারা দিন বাড়িতে যেন মেলা লেগে থাকত। সন্ধ্যার পরপরই তাদের পড়তে বসতে হতো। বিদ্যুৎ ছিলো না। হারিকেনের আলোই ছিলো ভরসা। পড়াশোনা শেষ করে রাত ৯টার পরপর ঘুমিয়ে পড়তে হতো। সে আর তার মামাত বোন মালা এক খাটে ঘুমাত। বড় ভূতের ভয় ছিলো মালার। তারা থাকত মামাদের দক্ষিণ ঘরে। এটা প্রাচীন আমলের ঘর। ঘরটি বানিয়ে ছিলেন নানার বাবা। পুরানো এই কাঠের দোতলায় মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। নানা আর নানী থাকতেন নিচের ঘরে। মেয়েরা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সেই জন্য তাদের থাকার ব্যবস্থা ওপরের ঘরে। রেহেনা আর মালা থাকত ঘরের একেবারে শেষের রুমে। ঘরের পেছনে পুরানো কালের ঘন জঙ্গল। বাঁশের ঝাড়। তেঁতুল বেথুল আরো কতো ! রাত হলে বনের মধ্যে এক ধরনের আওয়াজ শোনা যেত। এতে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো মালা। মাঝে মাঝে সে চিৎকার করে ওঠত। নানা নিচ থেকে বলতেন কিচ্ছু না। এটা খাটাসের আওয়াজ। মালা জড়িয়ে ধরত রেহেনাকে। তারা ঘরের জানালা বন্ধ করে ঘুমাত। জানালার নিচে একটা ছিদ্র ছিলো। যা দিয়ে প্রায় বেতবনের মধ্যে কিসের আলো দেখা যেতো। সবাই বলত ওটা নাকি হিন্দুপাড়ার কনিকার প্রেতাত্বা। প্রায় একশ বছর আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিলো কনিকা। তার আত্বা নাকি এখনো গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। রেহেনা যখন এসব স্মৃতিতে নিমগ্ন ঠিক সেই সময় ঘরে আসে পরিজান।
বুবু ঘুমিয়ে পড়েছো?
না।এসো ভিতরে। পরিজান ভিতরে আসে।
খবর শুনেছো বুবু?
কী খবর?
হারানদার ছেলে এসেছে, হারানদাকে নিয়ে যেতে?
তাই নাকি,কখন?
সন্ধ্যায়।ছেলেটা এখনো ওয়েটিং রুমে বসে আছে।
যেতে চাচ্ছেন না হারান দা।
না উনিতো ছেলেকে বকাঝকা শুরু করেছেন। যেতে চাইছেন না কিছুতেই।
ছেলে কিছু বলছে না।
না এই ছেলেটা আসলে কোন দোষ করেনি। সে জানতই না যে হারান দা কে এখানে পাঠানো হয়েছে।বহুকাল বিদেশ ছিলো ছেলেটা। ফিরেছে দুদিন আগে। উনাকে এখানে রেখে গেছেন উনার ছোট ছেলে।
তা হারান দা চলে যাক না ছেলের সঙ্গে। তারা তো ভুল বুঝতে পেরেছে।
না হারান দা বলেছে সে এখানে মরতে চায়,ছেলেদের কাছে নয়।কিছুতেই শুনছে না।তুমি একটা কাজ করবে বুবু?
কী কাজ?
আমার মনে হয় তুমি যদি হারান দা কে বুঝাও উনি যেতে রাজি হবেন।
আমার কথা কী শুনবে?
অবশ্যই শুনবে, তুমি হচ্ছে এই বৃদ্ধনিবাসের সবচেয়ে শিক্ষিত এবং জানাশোনা মানুষ। অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারো তুমি। একবার চেষ্টা করে দেখো না।
রেহেনার কোন সাড়া নেই।
কী ব্যাপার বুবু কথা বলছো না কেন? চলো যাই একবার আমরা দুজন মিলে চেষ্টা করে দেখি। সন্তান যখন ভুল বুঝতে পেরেছে তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়াই ভালো।
পরিজানের কথা শুনে অবাক হয় রেহেনা। এ মহিলাকে বোঝা বড় মুশকিল। এ ছেলে মেয়েদের গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন তো একটু পরেই তা ক্ষমা করে দিচ্ছে। বড় অদ্ভূত ভদ্র মহিলার আচরণ।
ও বুবু কথা বলছো না কেন? চলো যাই।
রেহেনা ও পরিজান হারান দার ঘরে যায়। হারান দা চৌকির এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। তাদের দেখে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করে।
আরে দিদি আপনারা আসেন। পরিজান ও রেহেনা বসে। কথা বলতে শুরু করে রেহেনা।
কেমন আছেন দাদা?
ভালো আছি, ভগবান ভালো রেখেছেন।
খেয়েছেন?
হ্যা দিদি।আপনাদের খাওয়া হয়েছে?
হ্যা।
তা দিদি হঠাৎ কী মনে করে আমার ঘরে?
শুনলাম আপনার ছেলে এসেছে?
হ্যা এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে কিন্তু আমি যাব না। হারান দার কর্কশ কণ্ঠ।
কেন দাদা ছেলে যখন এসেছে বাড়ি ফিরে যান। সন্তানেরা ভুল করবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমাকে দয়া করে অনুরোধ করবেন না দিদি? ওদের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।
আপনার এ ছেলে কি আপনাকে বৃদ্ধনিবাসে রেখে গিয়েছিল?
না এটা নয়, ছোটটা। এদের মধ্যে কোনো প্রার্থক্য নেই। মুদ্রার এ পিঠ আর ওপিঠ। অনেকটা রাজনীতির মতো।
তা বললে হয় না দাদা। সবাই কে সমান দেখা উচিত নয়। ছেলেটা সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। কিছু খায়নি মনে হয়। বাবা হয়ে সন্তানের প্রতি কোনো কর্তব্য আপনার নেই। আপনি ফিরে যান দাদা।
কোনো কথা বলেন না হারান। সন্তানের জন্য তার মন কেঁদে ওঠে। মুখে যতই শক্ত কথা বলুক না কেন এতোক্ষণ সে ছেলের কথাই ভাবছিলো। ছেলের কথা চিন্তা করেই রাতে ভাত খায়নি সে। রেহেনা আর পরিজানের কাছে মিথ্যা কথা বলেছে এক সময়ের স্কুল মাস্টার হারান ঘোষ। তিনি খাবারটা রেখে দিয়েছেন ছেলে বিধানের জন্য। সে জানে এখানে কোনো বাড়তি খাবার তৈরি হয় না। আশেপাশে কোনো হোটেলও নেই যে সেখান থেকে খাওয়া যাবে।
হারানের নিরবতা লক্ষ করে রেহেনা। ভাবে মন নরম হয়েছে হারান দার। সে বলে…
কী হলো হারান দা,কথা বলছেন না কেন?
রেহেনার কথার উত্তর না দিয়ে জসীমকে ডাকেন হারান দা। জসীম তাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ১৭ বছরের যুবক।
জসীম সম্ভবত পাশে ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে।
আমায় ডেকেছেন কাকা?
হ্যা। এই খাবারগুলো নিয়ে যাও । ওয়েটিং রুমে যিনি বসে আছে ও আমার ছেলে। খাবারগুলো ওকে দিয়ে এসো। ছোটবেলা থেকে আমার ছেলেটা ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু কাকা এটা তো আপনার খাবার।
তোমাকে যেটা বলছি সেটা করো।
খাবার নিয়ে বের হতে যায় জসীম। তাকে পেছন থেকে ডাকে হারান-
শোন। ওকে বলবে খাবার খেয়ে সকাল সকাল বের হয়ে যেতে। রাত বাড়লে গ্রামের বাড়িতে যেতে অসুবিধা হবে ওর। ছেলে মানুষ একা একা ভয় পাবে। ও এতোদিন দেশে ছিলো না। এখানকার হাবভাব কিছুই বুঝে না ছেলেটা।
তার কথা শুনে কাপড়ে দিয়ে চোখ মুছে রেহেনা এবং পরিজান। তারা বুঝে হারানের ভেতরের মানুষটাকে। সন্তানের জন্য তার ভেতরটা পুড়ে যাচেছ। কিন্তু বাইরে ভীষণ শক্ত। এই মানুষটার সঙ্গে ভিতরের মানুষটাকে কিছুতেই মেলানো যায় না।
দিদি আপনারা এখন ঘরে যান। আমি ঘুমাব।
হ্যা দাদা এক্ষুণি চলে যাব। রেহেনার উত্তর।
তাই যান রাত বাড়ছে।
কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলেন নাতো দাদা?
কোন কথার?
ওই যে আপনাকে ছেলের সঙ্গে ফিরে যেতে বললাম। যাবেন তো?
না, যাব না। আমি এক কথার মানুষ। ওদের জন্য এখন আর কোনো ভাবনা নেই আমার।
কিন্তু দাদা রক্তের সম্পর্ক তো অস্বীকার করা যায় না?
অস্বীকার করা যায় না এ কথা সত্যি। কিন্তু রক্ত নষ্ট হয়ে গেলে সে সস্পর্ক আর থাকে না। নষ্ট হয়ে যায়। ওদের গায়ে আমার রক্ত, এ কথা ঠিক। কিন্তু ওরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত নষ্ট হয়ে গেছে। পৃথিবীতে এমন ঘটনা অনেক হয়। শেষ পর্যন্ত বাবার রক্ত আর সন্তানের শরীরে থাকে না। একটানা কথাগুলো বলে থামেন হারান ঘোষ। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
এতক্ষণ চুপ ছিলো পরিজান। এবার সে মুখ খোলে
দাদা আপনি মাস্টার মানুষ। অনেক জ্ঞানবুদ্ধি আপনার। আপনার সঙ্গে আমরা কথায় পারব না। তাই বলছি ছেলেদের সব অন্যায় ক্ষমা করে দেন। বাকিটা জীবন ওদের সঙ্গে কাটান।
এর মধ্যে খাবার নিয়ে ফিরে আসে জসীম।
কীরে খাবার খায়নি বিধান?বলে হারান।
না কাকা।উনি বলেছেন আপনি ওনার সঙ্গে বাড়িতে ফিরে না গেলে কিছু খাবেন না উনি।
এখন কী করছে ও?
বসে বসে কাঁদছেন।
চলবে….( প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে উপন্যাসটি)
উপন্যাস : মুস্তাফিজুররহমাননাহিদ
প্রচ্ছদ : সাদিক আহমেদ