সমীর মজুমদার ও মোজাই জীবন সফরীর যৌথ চিত্র প্রদর্শনী
গ্রামীণ নিঃশব্দের কাব্য
খেয়া মেজবা, দ্য রিপোর্ট২৪ প্রতিবেদক : বাংলার গ্রামকে এস এম সুলতান চিনতে শিখিয়েছিলেন আলাদা করে। তার গ্রাম ভাবনা ছিল প্রবলভাবে মাটি ও মানুষঘেঁষা। বাংলার গ্রাম আধুনিক নগর জীবনের প্রভাব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে ক্রমশই হয়ে উঠছে নগরমুখী। কিন্তু শিল্পকলার ভুবনে সুলতানের গ্রাম ভাবনা এবং এর অন্তঃরস শিল্পরসিক এবং শিল্পবোদ্ধাদের কাছে আজীবন এক বিস্ময় হয়ে রইবে। সুলতানের ছবির মাধ্যমে আমরা পল্লী-গ্রামকে নতুনভাবে জানতে পারি। তার শিল্পকর্মে গ্রামীণ লোক-সমাজের স্বরূপটি খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার ল্যান্ডস্কেপ, মানুষের মধ্যকার সৌন্দর্য আবিষ্কার করার পেছনে ছিল সুলতানের নতুন ধরনের নন্দনভাবনা। সুলতানের গ্রাম দর্শন এবং তার স্পষ্ট ভাবনা বাংলাদেশের শিল্পীদেরকে নানাভাবেই প্রভাবিত করে। আর নবীন শিল্পীদের কাজে তার প্রভাব থাকা খুব অস্বাভাবিক নয়। শিল্পী সুলতানের সেই গ্রাম ভাবনার নন্দনবোধের পথে মিশেছেন প্রজন্মের দুই তরুণ শিল্পী সমীর মজুমদার এবং মোজাই জীবন সফরী। তাদের চিত্রকলার যাত্রা আরো আগে শুরু হলেও অন্তর্মুখী এবং প্রচারবিমুখী এই শিল্পীদ্বয় বর্তমানে তাদের শিল্পী জীবনের ধারাবাহিক কর্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন দর্শকের সামনে।
“যখন নিঃশব্দ শব্দকে খাবে” এমন এক শিরোনাম যেকোন দর্শকের মনে কৌতূহল জাগাতে বাধ্য। এই যান্ত্রিক বাস্তবতার যুগে এখনও যখন কোনো শিল্পী তার ভাবনায় যান্ত্রিক জীবন-যাত্রার বাইরে গিয়ে গ্রামীণ লোক জীবনের শিল্প রচনা করেন তখন বলতেই হয়, নিঃশব্দতা আসলেই শব্দকে খায়। কারণ গ্রাম জীবনের বাস্তবতায় শব্দের প্রকটতা অপ্রতুল। নিমগ্নতা, নির্জনতার মাঝে গ্রামীণ নিসর্গের মুখোমুখি হতেই যেন শিল্পীরা এই নাম বেছে নিয়েছেন।
গ্রামীণ লোক জীবনের শান্ত আবহাওয়া এবং নৈঃশব্দের চিত্র ফুটে উঠেছে সমর মজুমদারের তুলিতে। গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জের স্বল্প পরিসরে মধ্যে আবদ্ধ ক্যানভাসের ছবিগুলো শিল্পী সমরের নিপুণ ও পক্ক হাতের ইংগিত দেয়। তার এই সিরিজের ছবিগুলোতে ফিগারের স্টাইলাইজেশন এবং লাইনের বাঁক সামনে দাঁড়ানো দর্শকের চোখে থমকে দেবে; ক্রমাগতভাবে দর্শক ক্যানভাসের পরিসরের গল্পে ঢুকতে চেষ্টা করবে। পুরো ক্যানভাস জুড়েই রয়েছে স্পেস-এর পূর্ণ ব্যবহার। সমীর মজুমদার নিজে নিসর্গ এবং গ্রামীণ জীবনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট। নড়াইলে জন্মসূত্রে এবং সুলতানের স্কুলের ছাত্র হিসেবে তার জীবনদর্শন এবং জীবনযাত্রায় সুলতানের প্রভাব দেখা যায়। তার কলমে আঁকা ছবিগুলো তারই প্রমাণ রেখে যায়। বাংলার জনপদের মৌলিক ধারা এবং সেখানকার প্রাণশক্তি, নিসর্গ- এই সমস্তই হয়তো শিল্পী তার চিন্তাজগতে বয়ে বেড়ান। কলমে আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে নারী, পুরুষ, গরু, গাছ, পাখি, চাঁদ এই বিষয়গুলোর মধ্যে যে অঙ্কন পদ্ধতি এবং সেই সাথে পুরো ক্যানভাস জুড়ে এলিমেন্টের কম্পোজিশনের মধ্যে দক্ষতা রয়েছে। এর মধ্যেও শিল্প সৌন্দর্য লক্ষণীয়। এছাড়াও তার কোলাজসহ এক্রেলিকে আঁকা ছবিগুলোর নিসর্গমালায় বাংলার ক্ষয়িষ্ণু রূপকে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন। শিল্পী সমরের ভাবনায় যেমন কল্পনার জগত প্রাধান্য পায় তেমনি করে দৈনন্দিন জীবন-যাত্রা এবং পারিপার্শ্বিক সমাজ বাস্তবতাও জায়গা পায়। আর এই সব ভাবনাগুলোকে একত্রিত করে গ্রোথিত করেছেন তার ক্যানভাসজুড়ে। শিল্পী নিজে তার কাজ নিয়ে বলেছেন,“বাংলার প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে, পল্লী-পঠন সবুজ ছোঁয়া; প্রাণের প্রস্তুতি, জীবনের আহ্বান মিলিত মৌলিকত্বে প্রকৃতির খন্দ উপমায় অস্তিত্বের চেতনা সমৃদ্ধ করে।” তার বক্তব্য এবং তার ছবির ভেতরের কাব্যের রস- এই দুইয়ের মধ্যে তেমন ফারাক চোখে পরে না।
"বিধান চক্রঅন্ত ছল বন্ধ হলে তো, স্থায়ী রূপ মায়া, সত্য-বেভুল, - কাণ্ডকর্ম আঁকা যায়। মোহন বিনাশই যদি শাশ্বত, তবে ছলনের গাম্ভীর্যরূপ কি সত্য হয়? সবই তো পাতলা ন্যূন ও নাই... না এর নাট্যঃ না’ জীবন ধরিবার জন্যে, নয় মরণ করিবার- মাতিয়াছে আনন্দ মাতম- জমুক নাইয়ের আভাসে..."
মোজাই জীবন সফরীর কলাকথনে তার শিল্পের গভীর ভাব এবং দর্শনকে এভাবেই তুলে ধরেছেন। তার চিত্রভাষায় লৌকিক গ্রামবাংলার এলিমেন্ট এবং মানব শরীরের ব্যবহারে লক্ষ্যনীয়ভাবে ভিন্নতা চোখে পরে। তার কাজের ভেতরে এমন এক জগত নির্মাণ হয়েছে যেখানে এই রূঢ় সমাজের বিপরীতে গিয়ে নতুন এক গ্রামীণ সমাজের মায়াময় জগতের দেখা মেলে। ক্যানভাসে তেল রঙের মাধ্যমে আঁকা মানব শরীর আদিমতার প্রখর রূপ তৈরী করে। মোজাই জীবন সফরী তার ছবির মধ্যে শিল্পকলাকে সেই জায়গায় দেখার ইচ্ছা পোষণ করেন যেখানে থেকে তার কাজ যেন এই বাংলার শিল্পকলা হিসেবে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে চেনা যায়। এশিয়ান শিল্পকলার মধ্যে বাংলার শিল্পকলাকে আলাদাভাবে চেনার প্রয়াস তার কাজের মধ্যেই প্রমাণ মেলে। ল্যান্ডস্কেপের টেক্সচার এবং লম্বাটে গড়নের ক্ষিপ্র ফিগারের গতি এক অস্পষ্ট মায়াময় জগত নির্মাণ করে। ফ্ল্যাট কালো রঙে আঁকা ফিগারগুলোর গতিময়তা এবং পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার মধ্যকার সামঞ্জস্য শিল্পরসিকদের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করবে খুব সহজেই। শিল্পীর নিজের জীবন দর্শনের পূর্ণ রূপ যেন প্রকাশ পায় ক্যানভাসের গায়ের রঙের লেপনে। তার ছবির মধ্যে এক ধরনের সহজিয়া রঙ ও অংকন রীতি দেখা যায় তার মধ্যে আবার টেক্সচারের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পূর্ণ মেলবন্ধন রচিত হয়। শিল্পী তার ছবির ভাবনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলে, তিনি এই বাংলার এলিমেন্টের মধ্য দিয়েই কথা বলতে চেয়েছেন। তার চিন্তা জগৎ গড়ে উঠেছে বাংলার রূপ এবং প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কাছে তিনি তার ঋণ স্বীকার করেন।
এই দুই শিল্পীর জীবনধারণ এবং তাদের দুইজনেরই শহর বিমুখতার মধ্য দিয়ে তাদের ভাবনায় স্পষ্টভাবে চিরায়ত গ্রাম বাংলার রূপ দেখা যায়। তাদের শিল্প বিন্যাসের ভিন্নতা থাকলেও বিষয় নির্বাচন এবং গ্রামীণ জীবনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকার কারণেই হয়ত তাদের কাজের মধ্যে বর্তমান বাস্তবতার সংকট উচ্চারিত হয়।
(দ্য রিপোর্ট২৪/কেএম/এমডি/নভেম্বর ০৫, ২০১৩)