প্রভাবশালীদের দখলে জবির ১১ হল
প্রায় তিন দশক ধরে প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ১১টি হল। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালালেও হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর ড. হাবিবুর রহমান হল উদ্ধার হলেও তা আবাসন উপযোগী হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আট বছরেও আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত হয়নি শিক্ষার্থীদের।
এদিকে হলগুলো প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় তা উদ্ধারে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, আইন অনুযায়ী তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের সমস্ত সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু আমরা নিজেরা হল উদ্ধার করতে পারি না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সরকারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। আমরা এ ব্যাপারে চেষ্টা চালাচ্ছি। শিগগিরই হলগুলোর বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দ্য রিপোর্টকে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
জবির বেদখল হওয়া হল : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি হল প্রভাবশালীদের বেদখলে চলে গেছে।
আবদুর রহমান হল : আরমানিটোলা বটতলার ৬, এসি রায় রোডের হলটিতে বাস করছে পুলিশ সদস্যরা। ঢাকা আঞ্জুমান সংস্থা হলটি দখলের চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। ১৯৯৬ সালে সংস্থাটি মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করে। মালিকানার রায় পেলেও মামলা পরিচালনায় ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করায় সংস্থাটির সভাপতি কেএম আকবরের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে শাহবাগ থানায় মামলা হয়।
মূলত এর মালিক ছিলেন চিন্ময়ী দেবী। ১৯৬৫ সালে যা অর্পিত সম্পত্তি হয়। পরে তৎকালীন কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে থাকা শুরু করে। ১৯৮৫ সালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হলে তারা হলটি ছেড়ে দেয়। পরে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যের পরিবারের লোকজন বসবাস শুরু করে। তবে মূল ফটকে এখনও হলের সাইনবোর্ড রয়েছে। অক্ষত আছে অবকাঠামো।
শহীদ আনোয়ার শফিক হল : আরমানিটোলা মাহুতটুলির ১, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠার হলটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। পুরনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করে টিন, হার্ডওয়ার ও ফার্নিচারের গোডাউন তৈরি করেছে তারা। এদের অনেকেই ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী সেলিমের আশীর্বাদপুষ্ট বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোডাউনের কর্মচারীরা। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে হলটি ছাড়ে শিক্ষার্থীরা।
তিব্বত হল : পাটুয়াটুলী ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯নং জিএল পার্থ লেনের ৮.৮৮৯ কাঠার হলটিও দখলের অভিযোগ রয়েছে সাংসদ হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে হলটির স্থানে স্ত্রীর নামে গুলশান আরা সিটি মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন তিনি। প্রতিবাদে কয়েক দফা আন্দোলনেও নামে শিক্ষার্থীরা। তবে তিনি জায়গাটি তার নিজস্ব বলে দাবি করেছেন।
৯০-এর দশকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে স্থানীয়রা হলটির দোতলায় আগুন দিলে তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. হাবিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত ‘তিব্বত হল’ লেখা সাইনবোর্ড থাকলেও শিক্ষার্থীরা আর হলটিতে ফিরে যেতে পারেনি।
সাইদুর রহমান হল ও রউফমজুমদার হল : হিন্দুদের দানকৃত হল দুটির বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। মৌখিকভাবে দান করা সম্পত্তিটি জনৈক আইনজীবী ইব্রাহিম জাল দলিল করে বিক্রি করেন বলে জানা যায়। ১৫, ১৭ ও ২০ যদুনাথ বসাক লেন, টিপু সুলতান রোডের সাইদুর রহমান হলে হার্ডওয়ারের দোকান তৈরি হয়েছে।
পাশের রউফ মজুমদার হল জাল দলিলের মাধ্যমে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা বিক্রি করে দিয়েছে।
শহীদ আজমল হোসেন হল : পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭নং রমাকান্ত নন্দী লেনের হলটিতে বসবাস করত পুলিশ সদস্যদের পরিবার। কিছু অংশে গড়ে ওঠে ছিল বিভিন্ন সমিতি। ১৯৯৬ সালে একাংশ দখল করেন স্থানীয় মোশারফ হোসেন খান। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথিত ‘বেগম রোকেয়া (শহীদ পরিবার)’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে জায়গাটি দখল করা হয়। হলটির অবকাঠামো এখনও অক্ষত রয়েছে।
বজলুর রহমান হল : বংশালের ২৬, মালিটোলার হলটিতে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় বানানো হয়েছে। কিছু অংশ স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করেছে। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্ররা হলটি ছাড়ে।
বাণী ভবন : ১নং ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনের ৩৫ ও ৩৬ প্যারিদাস রোডের ১০ কাঠার বাণী ভবনের কিছু অংশে জবির কয়েকজন কর্মচারী বসবাস করলেও দুই-তৃতীয়াংশ বেদখল রয়েছে। আর স্থানীয়দের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে অবস্থানরত কর্মচারীরা। হলটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় পাবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য।
নজরুল ইসলাম হল : গোপীমোহন বসাক লেনের ৫/১,২,৩,৪ ও ৬নং টিপু সুলতান রোডের হলটির ২০ কাঠা জায়গায় গড়ে ওঠেছে জামেয়া শরীয়াবাগ জান্নাত মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সাবেক কমিশনার আওলাদ হোসেন দিলীপ এর তত্ত্বাবধান করছেন। হলটির একাংশ দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন বিটিভির সাবেক ক্যামেরাম্যান গোলামুন্নবী। তার আত্মীয়রা সেখানে অবস্থান করছে।
শহীদ শাহাবুদ্দিন হল : তাঁতীবাজার ৮২, ঝুলনবাড়ী লেনের হলটি দুই যুগেরও বেশি সময় পুলিশের দখলে ছিল। ২০০৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক এর দখল নেন।
কর্মচারী আবাস : তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আবাসস্থল ২৬, পাটুয়াটুলীর কর্মচারী আবাসে ছয়তলাবিশিষ্ট ক্রাউন মার্কেট তৈরি হয়েছে। জনৈক ওবায়দুল্লাহ এর মালিকানা দাবি করছেন বলে জানা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী বিলুপ্ত কলেজের সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ফার্মটির অনুসন্ধানে দেখা যায়, তৎকালীন কলেজের ১২টি হল ছিল। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে হলগুলো বেদখল হয়।
২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা হলে নীতি-নির্ধারণী মহলের টনক নড়ে। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক মাসের মধ্যে ১২টি হল ও বেদখল অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধারে সুপারিশ করতে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ২০০৯ সালের মার্চে ৫টি হল (আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, আজমল হোসেন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল) বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি।
একই বছরের ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয়ে ৫টি হলের দীর্ঘমেয়াদি লিজের আবেদন করে। ৯ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক আইনগত সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে হলগুলো লিজের পরিবর্তে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললেও একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা ও আইনি জটিলতায় হল উদ্ধার কার্যক্রম থমকে আছে।
দ্য রিপোর্ট/এলআরএস/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪