আবু সুফিয়ান (রা.) : ইসলামের দুশমন থেকে খেদমতগার

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : আবু সুফিয়ান বা আবু হানজালাহ (রা.)এর প্রকৃত নাম সাখর।তার পিতার নাম হারব ইবন উমাইয়া। আবু সুফিয়ান(রা.) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।জাহেলিয়া যুগে তিনি কোরাইশদের শীর্ষ তাদের অন্যতম ছিলেন। কোরাইশদের শাসনক্ষমতা তার হাতে ন্যস্ত ছিল।মক্কা বিজয়ের বছর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ছিলেন মক্কার কুরাইশ বংশের বনু আবদে শামস গোত্রের প্রধান নেতা।ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি নবী মুহাম্মদ(সাঃ)এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। উতবাহ ইবন রাবি'আহ এর কন্যা হিন্দ বিনতে উতবা ছিলেন তাঁর স্ত্রী।মুসলিমদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।মক্কা বিজয়ের পর নবী মুহাম্মদ (সা.) তাকে এবং তার স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর আবু সুফিয়ান নারজানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এছাড়া আবু সুফিয়ান ৬৩৬ সালের ইয়ারমুক যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে দ্বিতীয় চক্ষু হারান। তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর নাকিব হিসেবে যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার নাতি ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার নির্দেশের অধীনে যুদ্ধ করেন।
ইবনে সাদ (রহ.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের দিন আবু সুফিয়ান দেখতে পান, লোকেরা রাসূল (সা.) এর পেছনে চলছে, বিষয়টি তাঁর অন্তরে কিছুটা হিংসা সৃষ্টি করল। তিনি মনে মনে বলছিলেন, ‘আফসোস! আমি যদি পুনরায় এই ব্যক্তির (রাসূল(সা.)বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করতাম।’ এ কল্পনা করার পরপর রাসূল (সা.) আবু সুফিয়ানের বুকে হাত রেখে বলেন, ‘তবে আল্লাহ তোমাকে অপমান করতেন।’ প্রত্যুত্তরে আবু সুফিয়ান(রা.)বলেন, আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
তারপর তিনি নবীর মোজেজায় অবাক হয়ে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! বিষয়টি আমি মুখ খুলে কিছু বলিনি, কেবল অন্তরে তা কল্পনা করছিলাম।’ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর রাসূল(সা.)সাহাবিদের নিয়ে হুনায়নের যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। যুদ্ধ সংঘটিত হলো। মুসলমানরা জয়লাভ করেন।এ যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল হস্তগত হয়েছিল। রাসূল (সা.) গনিমত থেকে আবু সুফিয়ান (রা.) কে ১০০ উট দিয়েছিলেন। ইসলাম কবুল করার পর তার অন্তর যখন স্থির হলো তখন তিনি রাসূল (সা.)-এর কাছে গিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
তিনি রাসূল (সা.)কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি আমাকে তিনটি জিনিস দান করুন। রাসূল (সা.) তার এ প্রস্তাবে রাজি হলেন। প্রথম প্রস্তাবটি হলো-‘ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেভাবে জিহাদ করেছিলাম ঠিক সেভাবেই আমি যেনো কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি এবং আপনি আমাকে জিহাদের আমির বানিয়ে দিন।’ রাসূল(সা.) তার এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।’
পরবর্তী সময়ে তিনি তায়েফের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে তার এক চোখ হারান। তিনি এক চোখবিহীন হয়ে পড়েন। যুবায়ের (রা.) বর্ণনা করেন, সাঈদ ইবন উবাইদ সাকাফি বলেন, আমি তায়েফের যুদ্ধচলাকালীন সময়ে আবু সুফিয়ান (রা.)-এর দিকে তীর নিক্ষেপ করি।
তীরটি তার চোখে বিঁধল। নবী করিম (সা.)-এর কাছে তাকে আনা হলো। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল! এই আমার চোখ। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি যদি চাও, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তোমার চোখ ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর তুমি যদি চোখ ফিরে পেতে না চাও, তাহলে তোমার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। প্রত্যুত্তরে আবু সুফিয়ান বলেন, তাহলে আমি জান্নাতকে কবুল করলাম।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে রাসূল(সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকাল শুরু হলো। বেদুইন ও বিভিন্ন গোত্রের কিছু লোক মুরতাদ হয়ে পড়ে। একদল লোক জাকাত দিতে অস্বীকার করে। কিছু লোক নবীদের অনুসারী হয়ে পড়ে। ইসলামের এহেন মহাদুর্দিনে আবু সুফিয়ান(রা.)ইসলামের ওপর অটল ছিলেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধেও তিনি সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।রোমানদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
এ যুদ্ধে তিনি মুসলিম সৈন্যদের গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন।তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সৈন্যদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল।সৈন্যদের এক-তৃতীয়াংশ (যুবদল) প্রথমে রোমান সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে। তারপর বয়স্ক, সবশেষে মুজাহিদদের সন্তান-সন্ততি তাদের সাথে যোগ দেয়। এ যুদ্ধে প্রথমে আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রা.), আমর ইবন আস(রা.)সৈন্যদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। সবশেষে আবু সুফিয়ান (রা.)উপদেশ দেন।তিনি বলেন, ‘হে মুসলিম যোদ্ধারা!পরিস্থিতি তোমাদের অনুকূলে।তোমাদের সামনে রাসূল(সা.)ও জান্নাত অপেক্ষা করছে।আর তোমাদের পেছনে শয়তান ও জাহান্নাম অপেক্ষা করছে।’
বিখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব(রহ.)স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘একটি আওয়াজ সৈন্যদের কানে পৌঁছাল এবং সবাইকে শান্ত করে দিল। তা হলো- হে আল্লাহর সাহায্য, নিকটবর্তী হও! হে মুসলিম যোদ্ধারা, তোমরা দৃঢ়পদ হও! আমি তাকিয়ে দেখলাম, আওয়াজ প্রদানকারী হলেন স্বয়ং আবু সুফিয়ান(রা.)।এ যুদ্ধে তিনি তার দ্বিতীয় চোখটিও হারিয়ে পুরো অন্ধ হয়ে পড়েন।
এক সময় ইসলামের ঘোর শত্রু ছিলেন আবু সুফিয়ান(রা.)। ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধ পরিকল্পনাকারী, পরিচালনাকারী ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। জীবনের শেষাংশে রাসূল(সা.)এর কাছে ইসলাম কবুল করেন। ইসলামের পক্ষে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আল্লাহর রাস্তায় এক এক করে দুটো চোখই হারান।আবু সুফিয়ান ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন।
(দ্য রিপোর্ট/একেএ/এনআই/নভেম্বর ২৪, ২০১৬)