নিয়ন্ত্রণে আসেনি সমুদ্রের ২০০ নটিক্যাল মাইল
আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ‘অন ল অব দ্য সি’র সমুদ্রসীমা নির্ধারণী রায়ে সমুদ্রের জলসীমায় বিশাল অংশ দেশের আওতাভুক্ত হলেও পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেই কোস্টগার্ডের। এমনকি জনবল এবং অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে গভীর সমুদ্র এলাকায় কোস্টগার্ড প্রবেশই করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র কোস্টগার্ডের প্রশিক্ষণ দেবে ও আধুনিকায়ন করবে এ আশায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলেও জানা গেছে।
কোস্টগার্ড সদর দফতর সূত্র জানায়, ওই রায়ে বেস লাইন বা উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’ এবং ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বর্ধিত ‘মহীসোপান’ এলাকা কোস্টগার্ডের আওতায় আসার কথা থাকলেও দুই বছরেও নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি তারা।
সূত্র জানায়, ওই রায় অনুযায়ী সমুদ্র এলাকার ১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাংলাদেশের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা।
কিন্তু ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ঘোষিত রায়ের প্রায় দুই বছর পরও ওই এলাকার অপরাধ দমন এবং সম্পদ সংরক্ষণ তো দূরের কথা, মহীসোপান এলাকায় কোস্টগার্ড যেতেই পারছে না। মূলত জনবল এবং আধুনিক জলযানের অভাবে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গভীর সমুদ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছে না কোস্টগার্ড। আর এ কারণেই গভীর সমুদ্র এলাকার সম্পদ সংরক্ষণ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
জানা যায়, বিশাল উপকূলীয় এলাকার নিরাপত্তার জন্য কোস্টগার্ড সদস্য মাত্র দুই হাজার। অথচ এ সব এলাকায় প্রায় তিন কোটি মানুষের বসবাস। আর এর অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি মানুষই মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সেই হিসেবে আনুপাতিক হারে প্রায় সাড়ে সাত হাজার জেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে মাত্র একজন কোস্টগার্ড সদস্য।
শুধু জনবলই নয়, নেই অবকাঠামোগত সুবিধা এবং সমুদ্র গমনের জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজ ও বোট। সুন্দরবনের নদ-নদীসহ জলভাগের ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার টহলের জন্য ৩৪টি বিভিন্ন আকারের বোট রয়েছে। এমনকি সমুদ্র তীরবর্তী ৭১০ কিলোমিটার এবং উপকূলসংলগ্ন প্রায় ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটার টহলের জন্য রয়েছে মাত্র ১২টি জাহাজ। এর মধ্যে আবার অধিকাংশই পুরাতন, ছোট ও ধীরগতির কারণে সমুদ্রে গমনে অনুপযোগী।
এ কারণেই সর্বক্ষণিক নজরদারি, চোরাচালান প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা, জীবন ও জলযানের নিরাপত্তা প্রদান করতে পারছে না কোস্টগার্ড। এ ছাড়া উদ্ধারকার্য পরিচালনা, সমুদ্র দূষণ প্রতিরোধ ও সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
এ সব কারণেই রোধ করা যাচ্ছে না চোরাচালান, মানবপাচার, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। এর বাইরে উপকূলীয় এলাকার বনজ সম্পদ, সমুদ্রের মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
কোস্টগার্ড সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যে পরিমাণ অপরাধী ধরা হচ্ছে তার চেয়ে কয়েক গুণ অপরাধী এখনও সক্রিয় আছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের ধরা যাচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশের সমুদ্র পথকে অপরাধীরা নিরাপদ জোন হিসেবেই মনে করে। সরকারের পক্ষ থেকে এ সব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি ওই এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কোস্টগার্ড শক্তিশালী করারও উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার।
সূত্র জানায়, ভারত এবং মিয়ানমার থেকে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র নৌপথে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অস্ত্র ও মাদক আমদানির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে নৌপথকে।
জানা গেছে, কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে তিনটি প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। কোস্টগার্ডকে যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সহযোগিতা করবে এ আশায় অবহেলিতই থেকে গেছে এই বাহিনী।
দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার নদীপথ ও সমুদ্র এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নেই। এ সব এলাকার নিরাপত্তা, চোরাচালান প্রতিরোধ এবং সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের। কিন্তু এ বাহিনী কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। সরকারের অবহেলার কারণে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের উপ-পরিচালক (ইনটেলিজেন্স) বজলুল রশীদ বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কোস্টগার্ড এগিয়ে যাচ্ছে। কোস্টগার্ডের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিছু প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অপরাধ দমন এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনবল বাড়ানো, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আধুনিক জলযানের বিষয়ে প্রস্তাবগুলো করা হয়। কিন্তু এ সব প্রস্তাব এখনও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সমস্যা কেটে যাবে।
তিনি আরও জানান, আমেরিকা কোস্টগার্ডের আধুনিকায়নে এগিয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আশা করছি সীমাবদ্ধতাগুলো পর্যায়ক্রমে কেটে যাবে। এতে রক্ষিত হবে সমুদ্রের নিরাপত্তাও।
(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/এইচএসএম/শাহ/ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪)