পার্বত্য চুক্তির ১৯ বছরেও কাটেনি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক
এইচএম প্রফুল্ল, খাগড়াছড়ি : পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি ২ ডিসেম্বর। পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় দুই দশকের ধরে চলা সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের এই দিনে (২ ডিসেম্বর) পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর পর ১৮ বছর কেটে গেলেও এ চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি। সরকারপক্ষ বলছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্য ধারাগুলো সরকারের এই মেয়াদেই বাস্তবায়িত হবে। অপরদিকে জেএসএস’র অভিযোগ, সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করছে। এছাড়া আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পার্বত্য অঞ্চলের তিন সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস(সন্তু), জেএসএস(এমএন লারমা) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর মধ্যকার লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়।
চুক্তির পর গত ১৮ বছরে পার্বত্য অঞ্চলের তিন সশস্ত্র সংগঠনের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে তিন সংগঠনের অন্তত সাড়ে ৬ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে অসংখ্য মানুষের হতাহতের ঘটনা পাহাড়ে বাড়িয়ে দিয়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এসব সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা পাহাড়ের সম্প্রীতির উপরও আঘাত হানছে।
এদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও পাহাড়ি নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ উপজাতীয়দের মধ্যেও এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। সাধারণ মানুষের মতে, চুক্তির ফলে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং হানাহানি বেড়েছে। মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই। এছাড়া তিন সংগঠনের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ করেছেন সাধারণ মানুষ।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে এ চুক্তির ৯০ ভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। চুক্তির পর পাহাড়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়নের দ্বার খুলে গেছে।
গত মঙ্গলবার খাগড়াছড়ির রামগড়ের সোনাইপুল এলাকায় একটি সেতু পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে পরিপূর্ণভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী পাস হয়েছে। এতে দীর্ঘদিনের ভূমি জটিলতার অবসান হয়ে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির সমিতির (এমএন লারমা) সভাপতি সুধাসিন্দু খীসা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে এখনো অনেক বিষয় রয়ে গেছে। ভূমি কমিশন যদি যথাযথভাবে কাজ করে এবং কাজ করার জন্য যদি আন্তরিক হন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমস্যার কিছুটা হলেও পরিষ্কার হবে। সরকারের বিভিন্ন ভূমিকায় পাহাড়ে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের (পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিদের একটি সংগঠন) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক মিন্টু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে বলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বাঙালিদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ চুক্তির ফসল ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার পথ সুগম করেছে।’
এদিকে বর্ষপূর্তির দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবার বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২ ডিসেম্বর (শুক্রবার) সকাল সাড়ে ৮টায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চত্বরে শান্তির পায়রা উড়িয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে। খাগড়াছড়িতে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীরা নিজস্ব পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবে। শোভাযাত্রাটি জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ খেতে শুরু হয়ে চেঙ্গী স্কয়ার, শাপলা চত্বর হয়ে টাউন হল প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হবে। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা ও মনোজ্ঞ ডিসপ্লে’র আয়োজন রয়েছে।
একইদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী অস্ত্র সমর্পণস্থল খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন রয়েছে। এতে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যান্ড সোলস দর্শকদের মাতাবেন বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী। এছাড়াও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় স্থানীয় ও চট্টগ্রামের শিল্পীরাও অংশগ্রহণ করবেন।
অপরদিকে পার্বত্য চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায়িত করে ঐদিন সকাল ১১টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের ঘোষণা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় জনসংহতি সমিতির শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় দুই হাজার শান্তি বাহিনীর সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সরকার তৎকালীন সময়ে অস্ত্র সমর্পণকৃত শান্তিবাহিনীর সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দেন।
(দ্য রিপোর্ট/এস/এপি/ডিসেম্বর ০১, ২০১৬)