দুর্নীতির অভিযোগে সিটিভি জিএম’র অপসারণ দাবি
চট্টগ্রাম অফিস : বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের (সিটিভি) জিএম মনোজ সেনগুপ্তের অপসারণ দাবি করেছে চট্টগ্রামের সম্মিলিত শিল্পী সমাজ। সোমবার (০৫ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এ দাবি জানান শিল্পী সমাজের নেতৃবৃন্দ।
তারা অভিযোগ করেন, প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করার ঘোষণা দিয়ে সিটিভিতে চলছে লুটপাটের মহোৎসব। খোদ কেন্দ্র প্রধান মনোজ সেন গুপ্ত’র নেতৃত্বে একটি চক্র রাষ্ট্রীয় এই গণমাধ্যমে হরিলুটে মেতে উঠেছে। ফলে প্রতিষ্ঠার ২০ বছরেও রাজস্ব খাতভুক্ত না হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে দাফতরিক কাজে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের নতুন ইতিহাস।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অবিলম্বে এ দুর্নীতিবাজ জিএমকে অপসারণ না করলে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেবেন শিল্পীরা। জিএম’র দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে সিটিভি এখন সিসিটিভিতে পরিণত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সম্মিলিত শিল্পী সমাজের নেতা পংকজ বৈদ্য সুজন বলেন, নিম্নমানের অনুষ্ঠান, টেরিস্টেরিয়াল সম্প্রচার বন্ধ রাখা, অযোগ্য লোক দিয়ে টকশো পরিচালনা, তালিকাভুক্ত শিল্পীদের বাদ দিয়ে অখ্যাত শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করা, অডিশনের নামে বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত শিল্পী সমাজের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এম এম নজরুল ইসলাম, ফরিদ বঙ্গোবাসি, দিদারুল আলম দিদার, ফজলুল কবির চৌধুরী, সজল চৌধুরী, দিলীপ দাশ, এসবি সুমী প্রমুখ।
এর আগে একই অভিযোগ উঠেছিল সাবেক জিএম জ্যাঁ নেসার ওসমানের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবং শিল্পী সমাজের আন্দোলনের মুখে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তাকে বদলি করা হয়। তার স্থলে যোগদান করেন বর্তমান জিএম মনোজ সেনগুপ্ত। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতি আর অনিয়মের ধরন রয়ে গেছে অপরিবর্তিত।
মনোজ সেনগুপ্ত মূলত একজন প্রযোজক হলেও তাকে দেওয়া হয়েছে জিএম’র দায়িত্ব। বিটিভি মহাপরিচালকের আপন লোক হওয়ার কারণেই দাপটের সঙ্গে এসব অনিয়ম করেও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সিটিভিতে প্রযোজক থাকাকালীন আর্থিক অনিয়ম আর নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছিল। পরে পুলিশ পাহারায় সে সময় তাকে ঢাকা পাঠানো হয়।
জানা গেছে, সিটিভি’র ৩৬ কোটি টাকার আধুনিকায়ন প্রকল্পের অনিয়ম আড়াল করতে ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচারের তোড়জোড় শুরু করলেও অবশেষে রণেভঙ্গ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
৬ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সর্বশেষ প্রস্তুতি পর্যালোচনার জন্য গত ৩ জানুয়ারি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় প্রকৌশল শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে গেলে যে সব সমস্যা দেখা দেবে তা তুলে ধরেন।
প্রকৌশল শাখা থেকে জানানো হয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ২ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। তবে ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৬ ঘণ্টা বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ রাখতে হবে। কারণ একই সময়ে দুটি কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য আলাদা ট্রান্সমিটার নেই। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অঞ্চলের দর্শকরা ৬ ঘণ্টা বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখতে পাবে না। কার্যত চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এর আগে ৬ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরুর পদক্ষেপ হিসেবে বিটিভি কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার পদে রদবদল করে। জেনারেল ম্যানেজার জয়নাল আবেদীন সরকারকে ঢাকা কেন্দ্রে সংযুক্ত করে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বিটিভিতে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত অনুষ্ঠান শাখার মান উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালক জ্যাঁ নেসার ওসমানকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব বুঝে নিয়ে তিনি অনুষ্ঠান শাখায় নিয়ম বহির্ভূত জনবল নিয়োগসহ নানা অনিয়ম করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠান শাখায় প্রযোজক, এডিটর ও ক্যামেরাম্যান পদে ৪৬ জনকে নিয়োগ দেন।
নতুন করে অস্থায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়ার পর অনুষ্ঠান শাখার কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাশাপাশি অনুষ্ঠান নির্মাণ প্রায় বন্ধই বলা চলে। জেনারেল ম্যানেজার ও তার নিয়োগকৃত প্রযোজকদের পছন্দের কয়েকজন শিল্পী ও লোকজন দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আউটডোর অনুষ্ঠানের নামে যেনতেন অনুষ্ঠান বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিটিভি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের হিসাব শাখায় এক বছরের বেশি সময় ধরে সহকারী পরিচালক (অর্থ) পদে কোনো কর্মকর্তা নেই। প্রায় এক বছর ধরে প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি হিসাব শাখার দায়িত্বও পালন করেন।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী শিল্পী সম্মানী পরিশোধ বা যে কোনো ব্যয়ের পূর্বে জেলা হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা অফিসের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু জেনারেল ম্যানেজার সরকারি কোনো নিয়ম মানতে নারাজ। অনিয়মকেই তিনি নিয়মে পরিণত করেছেন। অভিযোগ উঠেছে শিল্পীদের নামে চেক ইস্যুর পাশাপাশি জেনারেল ম্যানেজার নিজের পকেটও ভারি করে চলেছেন।
অপরদিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের যানবাহন শাখায় জ্বালানি তেল বরাদ্দের নামে চলছে পুকুরচুরির ঘটনা। বিটিভি থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের যানবাহন শাখায় জ্বালানিখাতে মাত্র দুটি গাড়ির জন্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন ৬টি গাড়ির জ্বালানি তেলের জন্য স্লিপ দিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের পকেট ভারি করছেন।
এছাড়া বিভিন্ন শাখার জন্য মালামাল কেনার নামেও চলছে হরিলুট। জেনারেল ম্যানেজারের দফতরে ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছে ৭০ হাজার টাকার ক্রোকারিজ সামগ্রী। কর্মকর্তাদের জন্য ১০টি পানির ফিল্টার কেনার কথা বলা হলেও মাত্র ৫টির সন্ধান পাওয়া গেছে। মোদ্দা কথা বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনিয়ম-দুর্নীতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার মনোজ সেনগুপ্ত বলেন, আমাকে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রকে দুই ঘণ্টা থেকে ছয় ঘণ্টায় উন্নীত করার জন্য। আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। চট্টগ্রাম কেন্দ্র কবে নাগাদ ছয় ঘণ্টার সম্প্রচারে যাবে জানতে চাইলে এ বিষয়েও স্পষ্ট কিছুই বলতে পারেননি তিনি।
(দ্য রিপোর্ট/এমএইচএ/এপি/ এনআই/ডিসেম্বর ০৫, ২০১৬)