কাওসার আজম, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ফিরে : তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির দীর্ঘদিনের সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামেই বেশি পরিচিত। তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই উভয়পক্ষের মধ্যে এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেদিন।

চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯তম বর্ষে এসেও এখনও পার্বত্য তিন জেলায় বিশেষ করে পাহাড়ে শুনতে হয় সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। পাহাড়ের সর্বত্র জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন। অপহরণ, গুম, খুন, ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সরকার বলছে, চুক্তির অধিকাংশই শর্তই বাস্তবায়ন হয়েছে। আর জেএসএস বলছে বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ শর্ত। এ অবস্থায় সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে সই করা সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং অন্যদিকে চুক্তিবিরোধী পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারপন্থি গ্রুপের পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অশান্তির আগুনে জ্বলছে পাহাড়ের বাঙালি এমনকি সাধারণ পাহাড়িরাও।

তথাকথিত ‘পাহাড়ি জনগণের অধিকার’ আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস’র নেতৃত্বে পাহাড়ে শুরু হয় সশস্ত্র আন্দোলন। প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে রক্তাক্ত সবুজ পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি, বারুদের গন্ধ আর চরম অশান্ত পরিস্থিতির পর সংগঠনটি ১৯৯৭ সালের ০২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে। সরকারের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও বর্তমান আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পণ করেন সন্তু লারমা। আর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামসহ ৪টি স্থানে অস্ত্র সমর্পণ করেন শান্তি বাহিনীর এক হাজার ৯৬৮ জন সদস্য।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর কেটে গেছে ১৮টি বছর। সরকারের ভাষ্যমতে, এরই মধ্যে চুক্তির অধিকাংশ দফাই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে হানাহানি বন্ধে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল তা বন্ধ করেনি এই অঞ্চলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হয়নি এখনও। ফলে পাহাড়ে সেই কাঙ্খিত শান্তি ফিরে আসেনি। উল্টো দিন দিন আরো অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য অঞ্চল। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা দিন দিন তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। মজুদ বাড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদের। সীমান্ত হয়ে ঢুকছে এসব অস্ত্র। শান্তি চুক্তিবিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র উইংগুলোতো আছেই, এর সঙ্গে সন্তু লারমার জেএসএস এবং তার বড় ভাই (নিহত) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে এমএন লারমাপন্থি ‘জেএসএস সংস্কার’ গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুরো পাহাড়ি অঞ্চলকে অশান্ত করে রেখেছে। বাঙালিই শুধু নয়, তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না পাহাড়ি সাধারণ উপজাতিরাও।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)। পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও গাছপালাবেষ্টিত মনোরম দৃশ্যের এ ভূমিতে রয়েছে বাঙালি ও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর জন্য তা আজ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।

স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। এসব সংগঠনের প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীদের ভয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মুখ খুলতে ভয় পান। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারি এই এলাকায় চাকরি করেন, তারা শুধু দিন গুনেন ওই এলাকা থেকে কবে অন্যত্র বদলি হবেন। কোনো কোনো থানার ওসিও ভয়ে ওই সন্ত্রাসীদের তৎপরতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও সেখানে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়।

গত ২৯ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কর্মসূচিতে যোগদানের অপরাধে অপহরণ করা হয়েছিল দলের জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার এক ইউনিয়ন সভাপতি নীলবর্ণ চাকমা। ভয়ে তিনি বা তার পরিবার থানায় মামলা করতেও যাননি।

গত ১৩ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গতলী ইউনিয়নের হাগলাছড়া গ্রামে জেএসএস সংস্কারপন্থি গ্রুপের দুইকর্মী যুদ্ধচন্দ্র চাকমা (৩৫) ও নয়নজ্যোতি চকমাকে (৩২) অপহরণের পর কুপিয়ে হত্যা করেছে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে সাহস পায়নি নিহতদের পরিবার। ফলে পুলিশ বাদী হয়েই মামলা করা হয়েছে।

গত ৮ নভেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলাধীন ঘিলাছড়ি এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন মিনু ত্রিপুরা থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম ধর্মগ্রহণকারী আয়েশা সিদ্দিকী। মুসলিম ও বাঙালি যুবককে কেন বিয়ে করেছেন, এই অপরাধে তাকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। যদিও পরে তাকে নিরাপত্তাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে ছেড়ে দেয় একদিন পর। এ ঘটনায় তিনি বা তার পরিবার ভয়ে মামলা করেননি। এ ঘটনার রেশ না যেতেই ওই নারীর শ্বশুর মধু মিয়া ও আরেক প্রতিবেশির ২ একর জমির আনারসের বাগান কেটে নষ্ট করে সন্ত্রাসীরা।

এর আগে গত ২৯ মে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় এসএসসি পাস করা আয়না চাকমাকে অপহরণ করে গণধর্ষণ করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীরা।

বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অংচাখই কার্বারী বলেন, পার্বত্য এলাকায় চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। জেএসএস এবং ইউপিডিএফ এই চাঁদাবাজির সাথে জড়িত।

অংচাখই কার্বারী বলেন, ‘আমরা তো দাদা জঙ্গলে বাস করি। আমাদের জঙ্গলে যেতে হয়। পুলিশ তো সারাক্ষণ সাথে থাকবে না।’
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মো. মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, ঘটনা কিছু ঘটে ঠিকই, কিন্তু মামলা হয় না। বাদি কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পার্বত্য এলাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ ঘটনায় নিজের এবং পরিবার পরিজনের জীবননাশের ভয়ে মামলা করেন না। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য তিন জেলায় এ রকম বহু অপহরণ, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। যাতে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি। আবার মামলা করলেও জীবননাশের হুমকি এসেছে বা মামলার অগ্রগতি হয়নি তেমন।

গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির সাজেকে এক সেনাকর্মকর্তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার গাড়িতে আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় পাঁচ জেএসএস (সংস্কার) সন্ত্রাসী। উদ্ধার হয় বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র। একই বছরের ২৬ জুলাই রাঙ্গামাটিতে জেএসএস-ইউপিডিএফ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তিনজন এবং ২৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে জেএসএস-ইউপিডিএফের আরেকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল দেশি-বিদেশি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র।

এ ব্যাপারে পার্বত্য রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান বলেন, আগের চেয়ে পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভাল। থানায় মামলা হলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর মামলা না হলে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করছি। যেমন গত কিছুদিন আগে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে বাঘাইছড়িতে (জেএসএস) ২ জন যেখানে মারা গেল, বাঘাইছড়ি থানা থেকে ২৫ কিলোমিটার গহীনে। শুধু বাইরুটে নয়, নৌকায়, হেঁটে যেতে হয়। সেখানে যেতে একদিন লেগে যায়। ওই ঘটনায় কেউ থানায় মামলা করেনি। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের নিয়মিত টহল ও অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা বা সমতলের অন্য এলাকার সঙ্গে পার্বত্যাঞ্চলের তুলনা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্গম এলাকায় যাওয়ার জন্য রাস্তাঘাট নেই, অনেক সময় পাহাড়ের লোকজন আমাদের কথা বুঝেন না আবার আমরাও তাদের কথা বুঝি না। আবার দেখা যায়, একটা ঘটনা ঘটার পর ঘটনার ক্রাইমসিনে পৌঁছার পূর্বেই উপাদানগুলো নষ্ট করে ফেলা হয় বা হয়ে যায়। এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটি হচ্ছে এ্যায়ার্নেস। এখানে শিক্ষার হার খুবই কম। তাই জনসচেতনতার খুবই অভাব। আমরা পুলিশ হেল্পলাইন খুলেছি। কিন্তু এখানে সব জায়গায় নেটওয়ার্ক নাই।

পার্বত্য খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মজিদ আলীও দাবি করেন-‘পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভাল।’

পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, শুধু বাঙালি নয়, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের জুলুম অত্যাচারে সাধারণ পাহাড়িরাও অতীষ্ট। পাহাড়ে পুলিশও অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ থাকে। এসব সন্ত্রাসী একমাত্র সেনাবাহিনীকেই ভয় পায়। একের পর এক ঘটনা ঘটলেও পাহাড়ি থানাগুলোতে মামলার সংখ্যা সামান্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাঁদাবাজ ও অস্ত্রবাজদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমি আবেদন করেছি।

রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের মূল সমস্যা হলো অবৈধ অস্ত্র। এই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না পর্যন্ত এবং অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা অবস্থা ভাল হবে না। সরকারকে পর্যন্ত হুমকি দিচ্ছে তারা। প্রশাসনে যারা আছে, পুলিশ এবং সামরিক বেসামরিক তারা কাজ করছে। তারা কাজ করছে বলেই চাঁদাবাজি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে। মিলিটারিরা টহল দিচ্ছে বলে কিছু অবৈধ অস্ত্রসহ সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ছে। এখানে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে আরো এ্যাক্টিভ হতে হবে। অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, প্রশাসনকে সহায়তা সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এপি/ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬)