আরিফ সোহেল, দ্য রিপোর্ট : ৬১ রানের বড় হার; সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়ানডে সিরিজ খোয়ানোর বেদনাও। বাঁচা-মরার ম্যাচে ওই জোড়া কষ্টে স্বপ্নচ্যূত হয়েছেন দর্শকরা। অথচ প্রথম ম্যাচের সুখস্মৃতি বুকপাঁজরে সযতনে রেখে জয়ের সম্ভাবনার ভেলায় ভাসতে ভাসতে ক্রিকেটপ্রেমীরা বৃহস্পতিবার মিরপুরমুখো হয়েছেন। দিনের আলোতে সাঙ্গাকারার ব্যাটিং ঝিলিকের বিপরীতে মালিন্যে মেঘকালো রাতের ব্যাটিংপর্ব। ৯ রানে কৌশিক পেরেরাকে ফিরিয়ে দিয়ে ভিন্ন কিছুর আভাস দেয়া বাংলাদেশকে একাই উড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের জন্য যমের অরুচি বনে যাওয়া সাঙ্গাকারা। তার সেঞ্চুরির সঙ্গে প্রিয়াঞ্জন-ম্যাথুসও প্রাণখুলে ব্যাটিং করেছেন; তুলেছেন দ্রুতলয়ে রান। যা তাদের ২৮৯ রানের মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। আর রানের ম্যাচে অসহায় বাংলাদেশ শেষমেষ তুলেছে ২২৮ রান।

রোদেলা দিনে আগে ব্যাটি নিতে ভুল করেনি শ্রীলঙ্কা। টস জিতে হাতে ছিল সেই সুযোগ। তা শতভাগ কাজে লাগিয়েছেনও সাঙ্গাকারা-প্রিয়াঞ্জন-ম্যাথুসরা। তাদের ইনিংস; সেই কথারই রাজসাক্ষী। ৫০ ওভারে ২৮৯/৬। এখানে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি সাঙ্গাকারার। যে বাংলাদেশকে নিয়ে হামাশাই ‘ব্যাটেখেলা’ করে চলছেন। ১২৮ রানে সাঙ্গার ফিরেছেন দলের জয়ের পুজি অনেকটাই নিশ্চিত করে। যদিও প্রিয়াঞ্জনের সঙ্গে তার ১১৪ রানের যুগলবন্দি রানের পাশে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের অবদান স্মরণযোগ্যই। তারা খেলেছেন পাক্কা ২৪ ওভার। অথচ ০ রানে স্লিপে ক্যাচ দিয়েও মাহমুদউল্লার কল্যাণে বেঁচে গেছেন। ডিপ মিড উইকেটে দর্শনীয় এক ক্যাচ রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন নাসির। এবার জীবন পেয়েছেন প্রিয়াঞ্জন; তখন তার নামের পাশে মাত্র ২ রান। বোলার একজনই সোহাগ গাজী। পরের জুটিতে ৮৩ রান করেছেন সাঙ্গাকার-ম্যাথুসকে সঙ্গী করে। শ্রীলঙ্কান রানের মজুত ওখানেই দাঁড়িয়ে গেছে। ক্যারিয়ারের ১৭তম সেঞ্চুরির পথে সাঙ্গাকারা আবারো বাউন্ডারি মেরেছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩টি সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন ঠিক এভাবে বাউন্ডারিতে।

রুবেলে শুরুটা ভালোই হয়েছিল বাংলাদেশের। ৩৮ রানেই তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ২ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে । ম্যাচের দ্বিতীয় রুবেলের ব্যক্তিগত প্রথম ওভারেই কাট করতে গিয়ে পয়েন্টে শামসুর রহমানের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন কৌশল পেরেরা। আর দলীয় অষ্টম ওভারে রুবেলকে পুল করতে গিয়ে মিডঅফে মুশফিকুর রহিমের হাতে ধরা পড়েছেন তিলকরত্নে দিলশান। আর ১৩তম ওভারে সোহাগ গাজীর বলে মিডউইকেটে শামসুরের হাতে ক্যাচ দিয়ে চান্দিমাল চলে যাওয়ার পর রৌদ্রস্নাত স্টেডিয়াম আনন্দ-উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গিয়েছে। এরপর আশান প্রিয়াঞ্জন চতুর্থ উইকেটে সাঙ্গাকারার সঙ্গে ১১৪ রানের জুটি গড়ে শ্রীলঙ্কাকে বড় সংগ্রহের ভিত রচনা করেছেন। উইকেটে একটু ধীরস্থির থেকেছেন প্রিয়াঞ্জন। ৯৭ বলে ৬০ করা প্রিয়াঞ্জনকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেছেন সাকিব আল হাসান। প্রিয়াঞ্জনের বিদায়ের পর যেনো ম্যাথুস খোলস ছেয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন। তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে রানের গতি দ্রুতই বাড়তে থাকে শ্রীলঙ্কার। তার সাক্ষী পঞ্চম উইকেট জুটি। ওই জুটিতে সাঙ্গাকারার সঙ্গে মাত্র ৫৮ বলে ৮৩ রান তুলে নিয়েছেন ম্যাথুস। সিরিজে অভিষিক্ত বোলার আরাফাত সানিকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদে ধরা পড়েছেন সাঙ্গাকারা। সাঙ্গাকারার ১১৫ বলে ১৪টি বাউন্ডারি ১২৮ রান তুলেছেন। পরে রানের চাকা আরো সচল রেখেছেন অধিনায়ক নিজেই। ম্যাথুস ৩৯ বলে ৬টি চার ও ১টি ছক্কার সাহায্যে ৫৬ রানের উড়ন্ত এক ইনিংস খেলেছেন। সাঙ্গাকারা-ম্যাথুসরা শেষ ১০ ওভারে একশ’ রান তুলেছে। রুবেল দারুণ কার্যকর প্রমাণ করেছেন নিজেকে ৩ উইকেট নিয়ে। আর তার সঙ্গে সাকিব-সানি-সোহাগও নিয়েছেন একটি করে।

বড় রানের জবাবে মাঠে নামা। সেখানে লাসিথ মালিঙ্গার করা প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই স্লিপে তালুবন্দি শামসুর রহমান! ওভারপ্রতি রানের হিসেবটা যখন ৫.৮; তখন শুরুতেই এমন ধাক্কা বিপদেরই আভাস! তবে দ্বিতীয় উইকেটে এনামুল-মুমিনুল ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। দেখে-শুনে রানের দিকেও চোখ রেখেছেন। ১১.৪ ওভার খেলেও ফেলেছেন নতুন করে শুরু করা ‘দুই’ ওপেনার। তারা যখন রানে; তখন পেসার পাল্টিয়ে চতুর ম্যাথুস ডেকে পাঠিয়েছেন স্পিনারকে। সেনানায়েকের প্রথম টার্গেটের শিকার হয়েছেন মুমিনুল। তার ব্যাটে ছোঁয়া লাগা বলটি সাঙ্গাকারার সর্তক গ্লাভসে বন্দি ১৫ রানে; দলের তখন ৫৫ রান। ঠিক পরের ওভারেই এনামুল এলবিডব্লুর ফাঁদ। তার আউটে সত্যিই চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। এবারের বোলার তিসরা পেরেরা। তবে এমন বড় রানের টার্গেটের পেছনে ধাওয়ারটা সত্যি প্রমাণ করার ক্ষমতা রাখেন; মুশফিক-সাকিব জুটি খুবই দাপটের সঙ্গে ব্যাটিং করেছেন। ওই জুটি যতক্ষণ উইকেটে ছিল; ততক্ষণ ব্যাটে রান ওঠেছে পাল্লা দিয়ে। চতুর্থ উইকেটে সাকিব-মুশফিক ৭.২ ওভারে ৫৩ রানের জুটি গড়ে দলকে লড়াইয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অকেশনাল প্রিয়াঞ্জনকে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে উচ্চাভিলাসী সাকিব আবারো প্রমাণ করেছেন তার সময় ভাল যাচ্ছে না। ২৩ বলে ২৪ রান করা সাকিব আউট হওয়ার আগে ৪, ৬, ৪ মেরে গ্যালারিও রাঙিয়েছেন। এরই মধ্যে মাহমুদউল্লা, সোহাগ ব্যর্থ হয়ে বিপদটা আরো বাড়িয়েছেন। তারপরও নাসির ও মাশরাফির সঙ্গে শেষ চেষ্টায় নেমে মুশফিক হারের ব্যবধান কমানোর প্রচেষ্টা করেছেন; তাতে অনেকেই পুলকিতও হয়েছেন। উঠতে গিয়েও গ্যালারিতে ফের বসে থেকেছেন। মুশফিক-নাসির সঙ্গে ৩৭ রান তোলার পর অষ্টম উইকেটে ৪৭ রান তুলেছেন মাশরাফির সঙ্গে। মাশরাফি ২৩ বলে ঝটপট তুলে নিয়েছেন ১৭ রান। দুর্দান্ত এক ছক্কাও মন ভরিয়েছেন মাশরাফি। বলা যায়; মাশরাফি-মুশফিকের কিছুটা সময় গ্যালারিতে প্রাণের স্পন্দন জেগেছে। কিন্তু বাউন্ডারি সীমানায় মাশরাফি মেন্ডিসের বলে তিসারা পেরেরার হাতবন্দি হওয়ার পর আর ভিন্ন দৃশ্যপট তৈরি হয়নি। বরং মুশফিকুর রহিম ৭৯ রান নিয়ে একটুও হলেও আফসোস করেছেন। সাঙ্গাকারার সেঞ্চুরি দেখে মুশফিকও প্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু সঙ্গী কোথায়? তবে তার ব্যাটের ধার-ভারও যে কম নয় ২টি ছক্কা ও ৫টি চারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম উইকেটে ছিলেন বলে ততক্ষণ রানের আশা ছিল বাংলাদেশের। মালিঙ্গাকে পিটাতে গিয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচে পরিণত হয়েছেন মুশফিক। সেনানায়েকের ওই ক্যাচটি দ্বিতীয় ওয়ানডে অন্যতম সেরা ক্যাচ। শ্রীলঙ্কার পক্ষে সেনানায়েকে, পেরেরা, মেন্ডিস ও মালিঙ্গা ২টি করে উইকেট নিয়েছেন।

সিরিজের প্রথম ম্যাচ বীরের মতো হেরে শুরু করা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ম্যাচে হেরেছে অসহায়ভাবে। মোটের ওপর ৩ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজও শ্রীলঙ্কার। শনিবার শেষ ম্যাচ, সেখানে হয়তো সান্ত্বনা জয় জন্য মরিয়া হয়ে ওঠবে মুশফিক-সাকিব-এনামুলরা।

এই মিরপুরের পরিসংখ্যানের সর্তক চোখ ছিল শ্রীলঙ্কার। আগে ৩ ম্যাচে ২টিই স্বাগতিকরা জিতেছে। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে নিশ্চিত হারকে জয়ে রূপান্তরিক করেছে সফরকারীরা। এমনভাবে হেরেছে যা ক্রিকেটীয় শব্দমালার চিত্রানুভূতিতে প্রকাশযোগ্য নয়।

দ্বিতীয় ম্যাচে রোমাঞ্চিত হতে পারে এমন এক ম্যাচের দৃশ্যপট রচিত হয়নি বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংসে। বরং চলতি সিরিজে অহর্নিশ হারের অভ্যস্থতায় সীমাবদ্ধ থাকা বাংলাদেশের আরেকটি অপ্রাপ্তি যোগ হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সচকিত ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে।

গত ম্যাচের মতো দ্বিতীয় ম্যাচেও বাজে ফিল্ডিংয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। বিশেষ করে রুবেলের বলে ম্যাথুসের একটি সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন মাহমুদউল্লাহ। মুমিনুলও হাতছাড়া করেছেন ২টি ক্যাচ।

বাংলাদেশ মিরপুরে এর আগে বিগ রান চেজে জয় পেয়েছে ভারতের বিপক্ষে। ২০১২ ভারতের ২৮৭ রানের জবাবে ২৯৩ রান তুলে জয়ে পেয়েছে। ওই ম্যাচে ক্রিকেট কিংবদন্তি শচিন টেন্ডুলকার সেঞ্চুরিও পেয়েছেন। শ্রীলঙ্কার ২৮৯ রানের পর সেই সম্ভাবনার একটু হলেও মনের কোনে রিনিঝিনি শব্দে ঢেউ তুলছিল।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

শ্রীলঙ্কা : ২৮৯/৬, ৫০ ওভার (সাঙ্গাকারা ১২৮, প্রিয়াঞ্জন ৬০, ম্যাথুস ৫৬*; রুবেল ৩/৭৬, সানি ১/৪৪, সাকিব ১/৪৬, সোহাগ ১/৫০)।


বাংলাদেশ : ২২৮/১০, ৪৩ ওভার (এনামুল ৪২, মুমিনুল ১৫, মুশফিক ৭৯, সাকিব ২৪, নাসির ২২, মাশরাফি ১৭; সেনানায়েকে ২/৩৩, থিসারা ২/৪০, মেন্ডিস ২/৪৩, মালিঙ্গা ২/৪৫)।

ফল : শ্রীলঙ্কা ৬১ রানে জয়ী।

(দ্য রিপোর্ট/এএস/ওআইসি/ফেব্রুয়ারি ২০ ,২০১৪)