মতিনুজ্জামান মিটু, দ্য রিপোর্ট : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেছেন, বিটি বেগুনের জাত উদ্ভাবন একটি যুগান্তকারী ঘটনা।

বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে বারি’র গবেষণা বিভাগের পরিচালক খালেদ সুলতান, সেবা ও সরবরাহ পরিচালক শামছুন নূর, পরিকল্পনা পরিচালক ড. মখলেসুর রহমান এবং জীব প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ম. আল আমিন উপস্থিত ছিলেন।

জয়দেবপুরে ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে আলোচিত বিটি বেগুন নিয়ে মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, বেগুন একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি যা সারা বছর বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। এই সবজিটি উৎপাদনের প্রধান অন্তরায় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, যা বেগুনের সবচেয়ে ক্ষতিকারক প্রধান শত্রু পোকা হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চিহ্নিত হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের কৃষকেরা বেগুন উৎপাদনে উক্ত শত্রু পোকা দমনের জন্য প্রতি ২-৩ দিন অন্তর (এক মৌসুমে ১৬০-১৮০ বার) জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ঘন ঘন কীটনাশক ব্যবহারে বেগুনের উৎপাদন খরচও অনেক গুন বাড়ে যায় এবং কৃষকের কাঙ্খিত উৎপাদন সম্ভব হয় না।

বিটি বেগুনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ড. মণ্ডল বলেন, বর্তমানে কৃষকরা এই পোকা দমনের জন্য পরিবেশবান্ধব আইপিএম পদ্ধতি যেমন সেক্স ফেরোমেন ট্রাপ, আক্রান্ত ডগা কেটে সরিয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেও সম্পূর্ণরূপে সফলতা পাচ্ছেন না।

চিরায়ত প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি। উন্নত বিশ্বে আবিষ্কৃত কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের জিন (Cry I Ac) বাংলাদেশি নয়টি জাতে সংযোজন করে বিটি বেগুন নামে ৯টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যার প্রধান সুবিধা হলো- বেগুনের প্রধান শত্রু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ থেকে বেগুনকে রক্ষা করে, উদ্ভাবিত বিটি বেগুন এর জাত সমুহ হাইব্রিড না হওয়ায় নিজেদের বীজ কৃষকরা নিজেরাই উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে, বীজ কেনার জন্য প্রতি বছর কৃষকদের কোনো একক বীজ কোম্পানীর দারস্থ হতে হবে না, কীটনাশক ব্যবহার সীমিত হওয়ায় পরিবেশ দূষণ হবে না, কৃষকের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, উৎপাদন খরচ কম হবে এবং সর্বোপরি কৃষক তাদের কাঙ্খিত উৎপাদন বৃদ্ধিসহ আয় বৃদ্ধি করতে পারবে।

বিটি বেগুন দেশে আনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বায়োটেকনোলজিস্ট, উদ্ভিদ প্রজননবিদ, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ও কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারী টিম গঠন করে ২০০৫ সালে বিটি বেগুনের উপর গবেষণা আরম্ভ করে।

তিনি বলেন, পরিবেশ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে বায়োসেফটি কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে এবং বায়োসেফটি নিয়ম অনুসরণ করে ২০০৮-২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশের ৭টি স্থানে (জয়দেবপুর, জামালপুর, যশোর, হাটহাজারী, বরিশাল, ঈশ্বরদী ও রংপুর) বিটি বেগুনের উপর বহুস্থানিক পরীক্ষা করা হয়।

তিনি বলেন, প্রাপ্ত ফল সরেজমিনে দেখানোর জন্য স্থানীয় কৃষক, সম্প্রসারণ কর্মী, এনজিও প্রতিনিধি, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও গবেষকদের নিয়ে মাঠদিবস আয়োজন করা হয়। গবেষণায় প্রাপ্ত ফল বিএআরআই এর বার্ষিক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবছর মাঠ দিবসের সচিত্র প্রতিবেদন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে।

এ ছাড়া বিটি বেগুনের ফল ও এ বিষয়ে সচেতনা বাড়াতে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক, আঞ্চলিক পরিচালক, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের বিভাগীয় প্রধান ও ডীনদেরকে নিয়ে ৪টি কনসাল্টেশন কর্মশালার আয়োজন করা হয় বলে ড. মণ্ডল উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, বিটি বেগুনের গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বায়োসেফটি কমিটির সদস্য, দেশি বিদেশি গবেষক, নীতি নির্ধারক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিগণ পরিদর্শন করেছেন।

ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, দীর্ঘ ৮ বছরের বেশি সময় ধরে কর্ গবেষণার ফলের ভিত্তিতে এবং দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিএআরআই বিটি বেগুনের জাত অবমুক্তির জন্য এনটিসিসিবি (National Technical Committee on Crop Bio-technology) বরাবর আবেদন করে। এনটিসিসিবি এর কোর কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এনসিবি’তে (National Committee on Biosafety) প্রেরণ করে। এনসিবি পরবর্তীতে বিসিসি (Biosafety Core Committee) এর মাধ্যমে যথাযথ মূল্যায়ন করে তাদের সুপারিক্রমে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে বিটি বেগুনের ৪টি জাত অবমুক্ত করে।

Cry1 Ac জীন সমৃদ্ধ বিটি বেগুনের খাদ্যমান এবং রাসায়নিক উপাদানসমূহ দেশি বিদেশি উন্নত গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং এতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি বলে ড. মণ্ডল জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দশটিরও বেশি এক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরীতে মাছ, মুরগি, ছাগল, খরগোশ, ইদুর, মহিষসহ বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা করা হয় এবং তাদের উপর বিটি বেগুনের কোনো ক্ষতিকারক (Toxic) প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। এ সকল পরীক্ষার বিভিন্ন রিপোর্ট বিএআরআই কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত আছে।

‘জিএমও ফসল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক’ এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই বলে মহাপরিচালক ড. মণ্ডল জানান।

তিনি বলেন, পুষ্টিমাণ বিবেচনায় এটি প্রচলিত বেগুনের অনুরুপ। এ ছাড়া বেগুন একটি স্ব-পরাগায়িত উদ্ভিদ বিধায় স্থানীয় জাতের বেগুন বিটি বেগুন দ্বারা পরাগায়িত হওয়ার সুযোগ খুবই কম। বিটি বেগুনের জীন স্থিতিশীলতা পরীক্ষা করা হয়েছে; এক্ষেত্রে জিন মিশ্রণ জনিত কারণে স্থিতিহীন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সকল প্রকার প্রজনন পদ্ধতির মধ্যে GM (Genetically Modified) পদ্ধতি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত ও অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি পাওয়া যায়নি যা মানব স্বাস্থ্য, জীবজন্তু কিংবা পরিবেশের জন্য কোনো কুফল বয়ে আনতে পারে বলে মহাপরিচালক তুলে ধরেন।

মহাপরিচালক বলেন, কাঙ্খিত জাত উদ্ভাবনে চিরায়ত প্রজনন পদ্ধতির (Conventional Breeding) সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য পৃথিবীব্যাপী বর্তমানে জীব প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে কাঙ্খিত জাত পাওয়ার ক্ষেত্রে সময় এবং অর্থের সাশ্রয় হয়। বর্তমানে পৃথিবীর ২৮টি দেশে প্রায় ১৭০ দশমিক ৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে GM ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে এবং দিন দিন এর আবাদ বাড়ছে।

বিটি’র পৃথিবীব্যাপী অবস্থা তুলে ধরে মহাপরিচালক বলেন, জিন কৌশল প্রয়োগ করে বিভিন্ন দেশে যেসব ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে তার মধ্যে সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, পেঁপে, আলু, সুগারবিট প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য। আমেরিকাতে (২০১২) প্রায় ৬৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে GM ভুট্টা, তুলা, সয়াবীন, আলু, স্কোয়াশ ও সুগারবীটের আবাদ হয়। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে GM ভুট্টা, তুলা ও সয়াবিনের আবাদ হয়। একইভাবে কানাডাতে কেনোলা, সয়াবিন, ভুট্টাও সুগারবীটের এবং চায়নাতে তুলা, পেঁপে, টমেটোসহ বিভিন্ন GM ফসলের আবাদ হচ্ছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৯৯৬ সালে যেখানে GM ফসলের অধীনে জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন হেক্টর, ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭০ দশমিক ৩ মিলিয়ন হেক্টর হয়েছে। অতি সম্প্রতি বৃটেনে নাবী ধ্বসা (Late Blight) রোগ প্রতিরোধী জিএম আলুর জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

যুগে যুগে মানবকল্যাণে প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হবে এবং তা মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হবে এটাই স্বাভাবিক। বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকার, বাণিজ্য সংক্রান্ত অধিকার, প্যাটেন্ট ইত্যাদিসহ বিদ্যমান এবং অনাগত অন্য অনেক বিধিব্যবস্থা মেনেই জিএম ফসলের বাস্তবতাকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। গবেষক হিসেবে আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের সকলের থাকতে হবে। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের মত জনবহুল ও ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমির দেশে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় উৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে বিবেচিত হবে।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এসবি/ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৪)