বিধান সরকার, বরিশাল : পাখি বলতে বিকেল বেলা আসে শতেক জোড়া সাইবেরিয়ান সরাইল। আর মাত্র শ’চারেক পানকৌড়ির দেখা মেলে দিনের বেলায় জলকেলি করতে। বর্তমানে এমনই চিত্র পাখিদের অভয়ারণ্য বলে খ্যাত বরিশলের মাধবপাশায় অবস্থিত দুর্গাসাগর দীঘিতে। যেখানে এক সময় দেশি-বিদেশি মিলিয়ে লাখের অধিক পাখি থাকতো। পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠতো পুরো এলাকা। ভ্রমণকারীরা অপেক্ষায় থাকতেন সাঁঝের আগে একযোগে গোল হয়ে উপরে ওঠা লাখো পাখির ঘূর্ণায়মান অপরূপ দৃশ্য দেখতে। আশে পাশের গৃহস্থ থেকে দোকানিরা পর্যন্ত ছুটে আসতেন তা দেখার জন্য। এই নিয়ে দশ বছর হলো দুর্গাসাগর দীঘিতে পাখি শূন্য।

প্রহরী মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম সরদার (৬৮) জানান দুর্গাসাগরের ইতিবৃত্তসহ পাখি না আসার প্রধান কারণ। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা প্রজাতির পাখি দেখে আসছেণ। তাই ওদের অভ্যাস, চলন, ধরন যেন তার মুখস্ত প্রায়। এক কথায় পাখি বিশারদও বলা যায় তাকে। রানি দুর্গাবতীর নামে খনন করা এই দীঘিটি পাকিস্তান আমলে গর্ভনর মোনায়েম খান জমিদারদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করে মৎস্য বিভাগের অধীনে নিয়ে আসেন। তবে সংস্কারের অভাবে কচুরিপানায় ভরপুর দীঘিটি শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে যেত। ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এনে দীঘি খননসহ মাঝখানে পাখিদের সুবিধার্থে দ্বীপ নির্মাণ করা হয়। দীঘির উন্নয়নে আরো পরিকল্পনার কথা থাকলেও ৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর তা স্থবির হয়ে যায়। তবে দীঘিটি পুনঃখননের পর থেকেই অগ্রহায়ণের শুরুতে আসতে থাকা অতিথি পাখি চৈত্রের শেষ অবধি থাকতো। বিশেষ করে সাইবেরিয়া থেকে আসা সরাইলের সঙ্গে দেশীয় কিছু বালিহাঁস ও বলতে গেলে হাতে গোনা পানকৌড়ি মিলিয়ে লাখের অধিক পাখি দীঘির পানিতে আশ্রয় নিত। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দেখতে এসে লাখের অধিক পাখির একযোগে দীঘির সীমানা আকাশে ওড়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। তখন এলাকাটি পাখিদের অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই থেকে এলাকাবাসীসহ দর্শনার্থীরাও পাখি শিকার বা বিকট আওয়াজ করা থেকে বিরত থাকেন।

এক্ষেত্রে বাদসাধে ১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালে সিডর পরবর্তীতে ত্রাণের মালবাহী হেলিকপ্টার। ভয়াল সিডরে পাখিদের আদৌ কোনো ক্ষতি না হলেও কার্গো কপ্টারের বিকট শব্দ পাখিদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। রহমতপুর বিমানবন্দর কাছাকাছি। অপরদিকে সিডরে বিধ্বস্ত মঠবাড়িয়া, শরণখোলা যাবার রুট ছিল দীঘির উপর দিয়েই। ত্রাণবাহী এই কপ্টারগুলো বেশি উঁচুতে চলাচল করতো না বলে শব্দের মাত্রা অতিরিক্ত থাকায় ভয় পেয়ে পাখিরা চলে যেতে থাকে। প্রায় মাসব্যাপি ত্রাণ বহনের কার্যক্রম চলায় সেই থেকে নয় বছর পেড়িয়ে চলতি মৌসুমেও পাখি শূন্য দুর্গাসাগরের অবস্থা। এজন্য সিডর পরবর্তীতে আসা দর্শনার্থীরা যারা শুনতে পেয়েছেন দুর্গাসাগরে পাখি ওড়ার নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা, তারা এসে নানা প্রশ্ন করেন মোসলেম সরদারের কাছে।

এখানের পাখিরা ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই ঝাঁক বেঁধে খাবারের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়তো। আর ফিরে আসতো রাত পোহাবার আগে। খাদ্যের সন্ধানে যাওয়ার সময় পাখিদের কলকালিতে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে ভিড় জমে যেত। অমনি করে পাখিরা ফিরবার বেলায় দীঘির চারধারের গ্রামবাসীদের যেন জানান দিত। পাখিদের ডিম পাড়া নিয়ে এখানে প্রচলিত একটা প্রবাদ সম্পর্কে জানালেন দীঘিপাড়ের দোকানি আ. জব্বার। তাহলো দীঘি পুনঃখননের পর ১৯৮৮ সালে বেশ পাখি এসেছিলে অন্যবারের তুলনায়। এই পাখিরা দীঘির মাঝখানের দ্বীপে ডিম পাড়ত। এই ডিম স্থানীয় কয়েক যুবক সাঁতরে গিয়ে নিয়ে আসার পর থেকে আর এখানে ডিম পাড়েনি পাখিরা। তবে অতিথি পাখিরা ডিমে ঠিকমত তা দিতে পারতো না বলে এই ডিম থেকে কোনদিনই বাচ্চা ফুটতে দেখা যায়নি। নানা প্রজাতির হলেও এই পাখিদের মধ্যে ইউনিটি ছিল দেখার মতো। লক্ষাধিক পাখি একত্রে থাকলেও নিজেদের মধ্যে কখনোই বিবাদে লিপ্ত হতো না। একমাত্র শিলাবৃষ্টি ওদের ক্ষতিসহ প্রাণ সংহার করতো কখনো বা। বিশেষ করে সাইবেরিয়ান সরাইলের মাথা বেশ নরম। শিলাবৃষ্টি হলে পানিতে ডুব দিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইতো। তবে ডুব দিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারতো না বলে শিলার আঘাতে কিছু পাখি মারা যেত। এরমধ্যে ১৯৮৮ সালেই সর্বাধিক দুই হাজার পাখি মারা গিয়েছিল। এই ব্যতীত বার্ডফ্লু আতঙ্কের কালেও পাখির মৃত্যু হয়নি। দীঘিতে সরকারি মৎস্য চাষ রয়েছে। পাখি থাকালীন সময়ে পাখির বিষ্ঠাই থেকেই মাছের খাবারের যোগান হতো। মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পেত। এক দশক ধরে পাখি না আসায় মৎস্য চাষেও সংকট দেখা দিয়েছে। কমে গেছে পর্যটকসহ দর্শনার্থীদের সংখ্যা।

দীঘিরপাড়ে কথা হয় বরিশালের মুলাদি উপজেলা থেকে আসা ফিরোজ-কাজল দম্পত্তির সাথে। কাজলের নানা বাড়ি দীঘির কাছাকাছি রবীন্দ্রনগর এলাকায়। ছোটবেলায় নানা বাড়িতে বেড়াতে আসার অন্যতম আকর্ষণ ছিল দুর্গাসাগর দীঘির পাখি। পাখির জলকেলি বা উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ছিল দেখার মতো। কাজল জানান, তার চার বছরের কন্যা রইসাকে দুর্গাসাগরের পাখির গল্প অনেক শুনিয়েছেন। এবার রাইসাকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। তবে পাখির দেখা না পেয়ে অনেকটা আশাহত হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। এক সাথে লাখের অধিক পাখির ওড়াউড়ির দৃশ্য অনুপস্থিত। ওটা এখন গল্পই হয়ে রইল রইসার কাছে।

পাখি না আসায় পর্যটকদের হতাশার বিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, তারা চেষ্টা করছেন পাখি ফিরিয়ে আনতে। এজন্য দীঘিটি ঘিরে পাখিবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছেন। বিষটোপ বা অন্যকোনো উপায়ে কেউ যাতে পাখি ধরতে বা সমস্যা তৈরি করতে না পারে সেজন্য ৮টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করেছেন। আগের চেয়ে পাখির সংখ্যা বাড়তেও শুরু করেছে।

তবে আবার কবে আগের ন্যায় লাখো পাখির কাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠবে দুর্গাসাগর ফিরবার বেলায় এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল পাখি বিশারদ মোসলেম সরদারকে। কিছুটা বিমনা হয়ে খানিকটা সময় নিয়ে মেসলেম সরদার বললেন, সময় লাগবে। তাতে আরও ৫ থেকে ৭ বছরও লেগে যেতে পারে।

(দ্য রিপোর্ট/এস/এপি/ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৭)