মাতৃভাষার এ কী দশা!
আধুনিকতার নামে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার, প্রয়োগ এবং উচ্চারণে ভিন্ন ভাষার মিশ্রণ ও শব্দের বিকৃত উপস্থাপন প্রবণতা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার মৌলিকতা ও অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন ভাষা বিশেষজ্ঞরা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও অঞ্চল ভেদে ভাষার ব্যবহার, উচ্চারণ ও প্রয়োগের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভাষা বিশ্লেষকদের মতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে বহমান নদীর ধারা পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষারও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রভাবে মৌলিক ভাষা পরিবর্তিত হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় রূপ নেয়। আর এই রূপান্তরের ফলে সৃষ্ট ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চারণ ও শব্দের ব্যবহারেও তারতম্য দেখা যায়। যেমন- বরিশালের অধিবাসীরা তাদের কথ্য ভাষায় বাংলাকে যেভাবে ব্যবহার করেন তার সঙ্গে নোয়াখালীর অধিবাসীদের ভাষার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
ভৌগোলিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষার এমন পরিবর্তনকে প্রাকৃতিক বলে মনে করছেন ভাষাবিদেরা। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষার মিশ্রণ, শব্দের উচ্চারণ ও ব্যবহারে বিকৃতি করে নতুন এক ভাষার উদ্ভব ঘটিয়েছে। অনেকেই এই ভাষাকে বলছে এফএম ভাষা, কেউ বলছেন শর্টকাট ভাষা, আবার কেউ বলছেন ভাই-ব্রাদারের ভাষা। তবে ভাষার এমন চর্চা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মৌলিক অর্থাৎ মাতৃভাষা বলেই বিবেচিত হবে এমনটি মনে করছেন ভাষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
কীভাবে ভাষার বিকৃতি ঘটছে তার কিছু নমুনা- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র তৃতীয় বর্ষের দুই শিক্ষার্থী শাকিল রেজা রনি ও বেগ সজল রহমান। সহপাঠী হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যতাও বেশ। উত্তম বন্ধু বলতে যা বোঝায়, সেই সম্পর্কটিই রয়েছে এই দুজনের। শাকিলের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া আর সজলের খুলনা। একই বিভাগের দুটি জেলা হলেও কুষ্টিয়ার অধিবাসীদের কথায় কিছুটা উত্তরবঙ্গের টান রয়েছে। আর খুলনা, যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলের ভাষার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কথ্য ভাষায় উচ্চারণগত পার্থক্য নিয়ে ঢাকায় পড়তে আসা এই দুই বন্ধুর এখন কথ্য ভাষা একই রকম। তবে সে ভাষার সঙ্গে কুষ্টিয়া কিংবা খুলনাঞ্চলের ভাষার কোনো মিল নেই। এমনকি রাজধানীতে অবস্থান করার কারণে পুরান ঢাকা বা প্রমিত বাংলা উচ্চারণের ছাপও নেই তাদের মধ্যে। এই দুই বন্ধুর মধ্যকার একদিনের আড্ডার কথোপকথন ছিল এ রকম : চায়ের দোকানের সামনে চা ও ধূমপানরত সজলের কাছে শাকিলের হঠাৎ আগমন। সজল শাকিলকে সম্বোধন করে বলল, ‘‘আরে মাম্মা কোত্তে আইলি। তোরে তো সারসাইতে সারসাইতে (সার্চ-খোঁজা) আমার অবস্থা খারাপ। ফোনটাও অফ করে রাখছোস। পরে তোর জিএফ’রেও ফোন দিছি। ও তো কইলো তুই ওর সাথেও ছিলি না। কই আছিলি ক’তো?’’
শাকিল : ‘‘আর কস না মামা, এই জিএফটাকে নিয়ে ব্যাপক প্যানার মইধ্যে আছি। এমতে ক্লাস, এক্সাম নিয়ে আছি দৌরের উপ্রে, তার ওপর আবার জিএফ’র প্যানা। মাঝে মইদ্যে মুঞ্চায় ব্রেকআপ কইরা ফালাই।’
সজল ও শাকিলের মধ্যে এমন কথোপকথন তেমন কিছুই না। এখানে ভাষার সংক্ষিপ্তকরণ ও উচ্চারণের বিকৃতি এবং বিদেশি শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে। বিশেষ করে বর্তমানে বন্ধুকে সম্বোধনের একটি ‘জনপ্রিয়’ ডাক হল মাম্মা মানে মামা। এ ছাড়া প্রেমিকাকে সংক্ষেপে বলা হয় জিএফ (গার্লফ্রেন্ড), প্যানা অর্থ বোঝায় বিভিন্নভাবে বিরক্ত করা বা অধৈর্য করা। মুঞ্চায় অর্থ মন চাই দৌরের উপ্রে অর্থ দৌড়ের উপরে সহজ অর্থ ব্যস্ততা। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এমন হাজার হাজার শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে যার বিস্তৃতি ঘটছে এক মুখ থেকে অন্য মুখে। আভিধানিকভাবে এ সব ভাষা বা শব্দ স্বীকৃত না হলেও তার প্রভাব দেখা যায় দেশের বর্তমান ধারার নাটক ও টেলিফিল্মগুলোতে। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে গভীর রাতে এফএম রেডিওগুলোর আরজেদের (রেডিও জকি) কথোপকথনে।
সম্প্রতি দেশের একটি এফএম রেডিও’র নৈশ অনুষ্ঠানে আরজে যেভাবে বাংলা উচ্চারণ করছিলেন তা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের যেকোনো শিক্ষার্থীর ওপর সহজেই প্রভাব ফেলতে পারে। আর তরুণ প্রজন্ম রেডিও জকির এমন উচ্চারণকে ফ্যাশন বা আধুনিকতা মনে করে তার চর্চাও করতে পারে। অনুষ্ঠানটিতে একজন আরজের ভাষ্য ছিল এমন, ‘সুপড়িও লিসনাড়, আজ আমাদেড় অনুষ্ঠানে এক ব্যাপক ব্যাপাড় ঘটতে চলেছে। আজ আমাদেড় মাঝে আছেন, দেশেড় জনপিড়ো... এখানে আরজে ‘র’ উচ্চারণ ‘ড়’ এর মত করে নিজের ভাষ্যতে ভিন্ন আনতে চেয়েছেন। নিজেদের কথাগুলো অতি আধুনিক করতে গিয়ে তারা এভাবে উচ্চারণের বিকৃতি ঘটান।
এত গেল তরুণ প্রজন্মের কথ্য ভাষার বিকৃত রূপ। ফেসবুক, মুঠোফোনের খুদে বার্তা ও ব্লগের মত সামাজিক মাধ্যমে ইংরেজি বর্ণ ব্যবহার করে বাংলা ভাষা ও ইংরেজি ভাষার যে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে তা আশঙ্কাজনক।
সম্প্রতি আমার এক সহকর্মী আমার মুঠোফোনে খুদে বার্তায় লিখেছে ‘vai apnar jonno bacchar baboshtha koreci'. মুঠোফোনটি আমার স্ত্রীর হাতে থাকায় সে বার্তাটি পড়ল এভাবে, ‘ভাই আপনার জন্য বাচ্চার ব্যবস্থা করেছি।’ বার্তাটির তাৎপর্য জানতে চাইলে আমি নিজেও ভড়কে যায়। পরে আমার মনে পড়ল আমি আমার ওই সহকর্মীকে নতুন একটা বাসা খুঁজে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু সে বিষয়টি ইংরেজিতে না লিখে বাংলা করতে গিয়ে লিখেছে বাচ্চা।
ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তির ওয়াল লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিচিত্র রকম মন্তব্য। যেগুলোর ভাষা বুঝে ওঠা খুবই কষ্ট কর। যেমন অনেকেই f9, r8, tc, wc, 2me, tnx, এ ধরনের সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে। যদি কারো এ সব শব্দ সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে সে কিছুই বোঝবে না। উপরের সংক্ষিপ্ত ইংরেজি শব্দগুলো দিয়ে বোঝানো হয়েছে ফাইন, রাইট, টেক কেয়ার, ওয়েলকাম, তুমি, থ্যাংকস।
যদি কেউ অন্যের ওয়ালে এভাবে লেখেন, 2me amr ballo bondo, onk din tmr sate daka hai na. amk tomi bole gale. manas ato satapar hai.
এই ইংরেজি বর্ণ ব্যবহার করে সৃষ্ট বাংলা ভাষাটা অনেকেই পড়বেন এভাবে, ২মি এএমআর বাল্ল বন্ধু, ওনক দিন টিএমআর স্যাট ডাকা হায় না। এএমকে টমি বোল গেলে. মানাস অটো সাটাপার হায়।’
নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে এ সব কোড বা সংক্ষিপ্ত ভাষা খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদি কেউ এ সব ভাষা না বুঝে তাহলে সে অন্যদের কাছে হয় ক্ষ্যাত না হয় ‘আতেঁল’।
নতুন প্রজন্মের এমন সব ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা হয় স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র হাসান শেখের সঙ্গে। হাসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা বন্ধুদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলি এটা একটা স্টাইল। অনেকে একে এফএম ল্যাঙ্গুয়েজ বলে। আবার ভাই-ব্রাদার ল্যাঙ্গুয়েজও বলে।’
ভাই-ব্রাদার ভাষা কী জানতে চাইলে হাসান বলেন, ‘মূলত আজিজ সুপার মার্কেটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নাট্য জগতের একটি উত্থান হয়েছে। এখানে দেশের একজন চলচ্চিত্র ও নাট্যপরিচালক এবং তার জুনিয়র বন্ধুদের বলা হয় ভাই ব্রাদার। তারা সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জন্য যে সব নাটক বানাচ্ছে সেগুলোতে এ ধরনের ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। আর এ সব নাটক বেশ জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।’
এফএম রেডিও, টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার এমন অপমানজনক ব্যবহার রুখতে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার্থে একটি রিট দায়ের করা হয়। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিত হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি একটি রুল জারি করে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ দেওয়ারও নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এমন নির্দেশে সরকার বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও অ্যামিরেটস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির মাধ্যমে বাংলা ভাষা কীভাবে বিকৃত হচ্ছে এবং তা রোধের বিষয়ে তদন্ত করে হাইকোর্টে জমা দেওয়ারও নির্দেশ দেন ওই বেঞ্চ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টে ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ এইচ এম সামসুদ্দিন চৌধুরী আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলে বেঞ্চটি ভেঙে দেওয়া হয়। আর এতে ওই কমিটির দেওয়া রিপোর্টটি এখনও ঝুলে রয়েছে। নতুন বেঞ্চে রিটটির কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় রুলের কার্যকারিতা ও আদেশের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলা ভাষার বিকৃতি ও ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ভাষাবিদ অধ্যাপক ড. হায়াত মাহমুদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার যে নোংরা চর্চা চলছে তাতে প্রকৃত মৌলিক বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ভবিষ্যতে থাকবে কিনা সেটায় প্রশ্ন।’
হায়াত মাহমুদ বলেন, ‘বিদেশি চ্যানেলের দৌরাত্ম্য, দেশের এফএম রেডিওগুলোর উপস্থাপকদের ভাষার ব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে এ সব ভাষায় কথা বলতে ও চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করছে। তা ছাড়া স্কুল, কলেজগুলোতে অযোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে পাঠদান করানোর ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা ভাষা জ্ঞানে সমৃদ্ধ হচ্ছে না। প্রমিত বাংলা ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় এ সব প্রজন্ম ইংরেজি, হিন্দি আর বাংলা ভাষার মিশ্রণে সৃষ্ট জগা-খিচুরি ভাষায় অভ্যস্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া একটা বিশেষ গোষ্ঠী আমাদের নাটক ও সিনেমাতে প্রমিত বাংলার বদলে এ সব ভাষাকে স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে ভবিষ্যতে প্রমিত বাংলাটি নতুন প্রজন্মের কাছে কৃত্রিম বলে মনে হয়।’
বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার্থে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আদালত থেকে রুল দিতে হয়। একটি দেশের ভাষার প্রচার ও প্রসার ঘটে শিল্প, সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু শিল্প চর্চার নামেই তো অশুদ্ধ ভাষার চর্চা চলছে। আর বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার জন্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহও নেই। বইয়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের আকর্ষণ কম। যারা যতটুকু বই পড়ছে তাও মানসম্মত নয়। বাজারে মানসম্মত নতুন বই আসছে না।’
ভাষার বিকৃতি রোধে দেশের শিক্ষক সমাজকে বেশি উদ্যোগী হওয়া দরকার বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘ভাষা বিকৃতির প্রবণতাকে আমলে নিয়ে এর বিরুদ্ধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। অপসংস্কৃতি ও বিকৃত ভাষা যাতে প্রয়োগ না হয় সে দিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।’
আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এভাবে যদি বাংলা ভাষার বিকৃতি চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এটা বিশ্বাস করানো কষ্ট হবে যে, বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সাহিত্য চর্চা করেছেন। তখন দেখা যাবে মৌলিক বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের ভাষা না বলে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বলে বিবেচনা করা হবে।’
(দ্য রিপোর্ট/আরএইচ/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৪)