নিজভূমে অবহেলিত বাংলা ভাষা
উৎকর্ষ সাধন-গবেষণায় কোনো পরিকল্পনা ও বরাদ্দ নেই
সোহেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : ভাষার জন্য রক্ত দিলেও নিজভূমে অবহেলিত বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষার পরিচিতি ও মর্যাদা বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই। আর পরিকল্পনা না থাকায় এ সব খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দও নেই।
প্রসঙ্গত, বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা। বিশ্বের প্রায় ২৩ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ স্থাপনের ঘোষণা দিলেও সেটি এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ‘বাংলা একাডেমি’ থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির জন্য সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ মাত্র ৬ কোটি টাকা। বাংলা একাডেমিতে ‘বাংলা ভাষা শিক্ষা কোর্স’ পাকিস্তান আমলে চালু থাকলেও এখন নেই। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলা ভাষা নিয়ে নেই কোনো ডিগ্রি ও উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স।
ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে বিদেশি ভাষা (ইংরেজি, ফরাসি, রাশিয়ান, চীনা, স্প্যানিশ, জার্মান, কোরিয়া, জাপানি, হিন্দি, আরবি ইত্যাদি) প্রশিক্ষণ ও প্রসারের জন্য প্রতিটি দেশেরই নিজ নিজ উদ্যোগ রয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল, আলিয়াস ফ্রঁসেস, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠান ভাষাগত প্রশিক্ষণের পাশপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ব্যবসায় বাণিজ্যের বিষয়টি তুলে ধরে থাকে। তাদের মতো বাংলা ভাষারও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রসারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেন।
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বাংলা ভাষা অনেকেই সঠিকভাবে বলতে ও লিখতে পারে না। বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে বলা এবং লেখা শেখানোর জন্য অবশ্যই দেশে বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থাকা দরকার। এ জন্য বাজেটও দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থের কথা সামনে রেখে এগোতে হবে।’
বাংলা ভাষা বিদেশে সম্প্রসারণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা বিদেশে সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন প্রচারণা। পৃথিবীর অনেক ভাষা আছে, যার ভাষাভাষির সংখ্যা আমাদের থেকে অনেক কম। কিন্তু সেই ভাষাও এখন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য দরকার প্রচারণা।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষার কোর্স না থাকার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগে বাণিজ্য ছাড়া আর কিছুই করত না। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে আমরা এগুলো বন্ধের চেষ্টা করছি। আগামীতে আমরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ’ খোলার জন্য বলব। তখন তারা যদি এটি না মানে, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘বাংলা ভাষা পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই পড়ানো হয়। পৃথিবীব্যাপী বাংলা ভাষা চালু করতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এ জন্য দাতাগোষ্ঠীরও সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা কোর্স চালু করতে হলে সেখানে খরচ বহন করতে হয়।’
বাংলা একাডেমিতে বাংলা ভাষা কোর্স চালু করার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমিতে ৬০ এবং ৭০-এর দশকে বাংলা ভাষা কোর্স চালু ছিল। কিন্তু তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এখানে বিদেশিরা ভাষা শিখতে আসত না। তাই এটি বন্ধ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আর এখন বিদেশিরা দেশে এসে গুলশান-বনানীতে ওঠেন। তারা বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বাংলা ভাষা শেখেন। বাংলা একাডেমিতে আসেন না। তাই এটি বন্ধ আছে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষার কোর্স না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানো হয় না। এটা খুবই দুঃখজনক। তাই সরকারের উচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালুর বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা। অন্যথায় এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এজেড/এইচএসএম/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪)