বিধান সরকার, বরিশাল : এখন থেকে ২২২ বছর আগের কথা। বানরীপাড়া উপজেলা সদর লাগোয়া সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বেতাল গ্রাম ছিল জমিদার গঙ্গু সরকারের পূর্ব পুরুষদের অধীনে।

প্রচলিত মিথ অনুযায়ী এক কৃষক জমিতে হালচাষ করতে গেলে লাঙ্গলে ফলা আটকে থমকে দাঁড়ায় গরু। কোদাল দিয়ে মাটি সরিয়ে দেখতে পান কালো ধরণের পাথরের কিছু একটা। তা তুলে নিয়ে যাওয়া হয় জমিদার সরকার বাড়ির কাচারীতে। ধুয়ে মুছে দেখতে পান স্ত্রী ছায়া, পুত্র শনি এবং কন্যা সঙ্গা সমেত সূর্যদেব দাঁড়িয়ে।

হিসেব অনুযায়ি ১৭৯৫ সালের ওইদিন ছিল মাঘী সপ্তমী তিথি। আর জমিদার পত্নী স্বপ্নে অদিষ্ট হওয়ায় পর থেকে শুক্লা পক্ষের ওই তিথীতে রোগ, তাপ, রাহু বালাই থেকে মুক্ত আর জমির উর্বরা বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের আশায় শুরু হয় সূর্য দেবের পূজা। সময়ের ব্যবধানে সূর্যমনির মেলা এখন একদিন থেকে সপ্তাহ পেরিয়ে পক্ষকাল ছাড়িয়ে মাসব্যাপী হচ্ছে।

মেলার প্রধান আকর্ষণ নিত্য ব্যবহার্য গ্রামীণ তৈজসপত্র। এর সঙ্গে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র ও হরেক রকমের খাবারের দোকান। আর বিনোদনের জন্য রয়েছে পুতুলনাচ, নাগরদোলা, যাত্রা ও সার্কাস এমন কথা জানান দুই সন্তান নিয়ে মেলায় আসা নেয়ামতউল্লাহ।

ছোটবেলায় তিনিও বাবার হাত ধরে একই ঢঙে সূর্যমনির মেলায় আসতেন। ওই স্মৃতি নিয়ে সন্তানদের কাছে গল্পও করেছেন অনেক। ওই সময় মেলার পরিধি আরও বড় ছিল এখনকার চেয়ে।

মেলার উত্তর পাড়ের ইছানী খালের পাড়ে বসত মাটির তৈজসপত্রের দোকান। পূর্বদিকে রাস্তা পেরিয়ে থাকতো কাঠ ও বেতের আসবাবপত্রের দোকানীরা।

সূর্যদেবের মন্দিরের সামনের অংশ জুড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ মিষ্টি ও মুড়ি-মুড়কির দোকান। এই মেলার জিলাপীর স্বাদ আজো যেন মুখে লেগে আছে।

আক্ষেপ করে নেয়ামতউল্লাহ বলেন, কয়েক বছর ধরে জঙ্গী হামলার আতঙ্কের কারণে মেলায় লোকসংখ্যা কমেছে। আর জমির মালিকদের বাড়তি টোল ওঠানোর কারণে কমেছে দোকানীদের সংখ্যাও।

পার্শ্ববর্তী গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া গ্রামের সুনীল দেওয়ান এসেছেন বাঁশ ও বেতের তৈরি গ্রামীণ ব্যবহার্য পণ্য কুলা, চালাইন, ডালা, সাজি, ঢাকনী, খাড়ই, বেতের মড়া আরো কত কি! তিনি দেড়যুগ ধরে সূর্যমনির মেলায় আসেন। প্রথমদিকে বেচাকেনা একটু খারাপ হলেও শেষ দিকে বেশ জমেছে।

আর কাঠের ড্রেসিং টেবিল, খাট, আলনা, ওয়ারড্রবসহ যাবতীয় আসবাবপত্র নিয়ে এসেছেন বানারীপাড়া এলাকার আউয়াল মিস্ত্রী। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে তারা এসব ফার্নিচার তৈরি করেন। শুকনো মৌসুম হলে বিভিন্ন মেলায় দোকান নিয়ে উপস্থিত হন। তাদের তৈরি ফার্নিচারের গুণগত মান ভালো হওয়াতে বেচাকেনাও ভালো হচ্ছে।

লক্ষণ দাস সার্কাস আর যাত্রার সাথে পুতুল নাচের তিনটি দল নিয়ে এসেছে মেলায়। নিজাম-২ পুতুল নাচ দলের পরিচালক নড়াইলের জাফরান মোল্লার রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি সংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে থাইল্যান্ডের পুতুল নাচ দেখানোর অভিজ্ঞতা। তারমতে সূর্যমনির মেলা অনেকটা নিরুপদ্রব। কোনো অশ্লীলতার বালাই বা উপদ্রব নেই। এখানে আগের চেয়ে দর্শকের উপস্থিতি কমেছে বটে, তবুও বেশ ভালোই হচ্ছে মাসব্যাপী এই পুতুল নাচ।

জাফরান মোল্লার কথায় মিল পাওয়া যায় মেলা আয়োজক কমিটির সহ-সম্পাদক ধ্রুব সাহার কথায়। তিনি আশা করেন, প্রশাসনের সহায়তা পাওয়ায় ৪ মার্চ পর্যন্ত চলমান মেলার সমাপ্তি শান্তিপূর্ণই হবে।

এখানে মানত করলে ফলন ভালো হয়, রোগ তাপ, রাহু মুক্ত হওয়ায় যায় বলে জানান মানতের ডালা নিয়ে আসা সন্ধ্যা নারী। তিনি সূর্যদেবের কাছে পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন। একসময় এখানে মানতের জন্য কাড়ি কাড়ি ধান ও নগদ অর্থ জমা হতো। তা এখন অতীত বলে জানালেন মন্দিরের পূজারি কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্য্য।

সূর্য দেবের বর্তমান প্রতিমাখানি মাটির তৈরি। কালো কষ্টি পাথরের ৫ ফুট উচ্চতার মূল প্রতিমাখানি দেশ স্বাধীনের আগে চুরি হয়। এরপর মাটির তৈরি প্রতিমা দিয়েই প্রতিবছর মাঘ মাসের সপ্তমী তিথীতে চলে আরাধনা। এতে যোগ দিতে দেশের বাইরে থেকে ভক্তরা এসছেন বলে জানান বংশ পরম্পরায় পূজারীর দায়িত্ব পালন করা কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্য্য।

(দ্য রিপোর্ট/কেএনইউ/এআরই/ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭)