দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক প্রায় ১৬.১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভোগেন। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ রোগের হার ১৮.৪ শতাংশ। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, দুশ্চিন্তা ও পরিবেশগত নানা কারণে এই বিষণ্নতা। বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ মানসিক রোগ বা বিষণ্নতায় আক্রান্ত। ২০০৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত বিষণ্নতার হার ১৮ শতাংশ বেড়েছে।  দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার এই মানসিক রোগীদের চিকিৎসার প্রধান বাঁধা। তবে চিকিৎসা বলতে শুধু ওষুধ নয়, পরিবার তথা বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব এবং নিকটজনরাই এই রোগের প্রথম চিকিৎসক, এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন মনরোগ বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বিকেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ‘আমার হেলথ ডটকম’ নামের একটি সংগঠন আয়োজিত এক সেমিনারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেছেন। ‘আসুন বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলি’ শিরোনামে আয়োজিত এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান খান।

মূল প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। ২০১৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত এ রোগের আক্রান্তের হার ১৮ শতাংশ বেড়েছে। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় ১৬.১ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিষণ্নতার হার ১৮.৪ শতাংশ। প্রতি দশজনের একজন জীবনের কোনো সময় বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অর্থাৎ ৪.৬ শতাংশ ও শিশু-কিশোরদের ১ শতাংশ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। ২০১৬ সালের স্বাস্থ্য অধিদফতর ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট-এর একটি জরিপে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১২.৭ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছে।

বিষণ্নতা আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান খান জানিয়েছেন, সাধারণত ১৮-৪৪ বছর বয়সী নারী-পুরুষের বিষণ্নতা বেশি দেখা যায়। ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও বয়সভেদে যে কেউ বিষন্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। অস্বস্তি লাগা, হতাশ, বিষণ্নভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, আনন্দের কোনো খবরেও আনন্দিত না হওয়া, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া ও নিজেকে সবসময় হীন, তুচ্ছ বা অকর্মণ্য মনে করা এবং কৃতকর্মের জন্য সবসময় নিজেকে অহেতুক দোষারোপ করা বিষণ্নতার অন্যতম লক্ষণ।

বিষণ্নতা আক্রান্ত রোগীর আরও কিছু লক্ষণ তুলে ধরা হয় মূল প্রবন্ধে। এগুলো হলো-বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি সহজেই সব কিছু ভুলে যায়, মনোযোগ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। অল্পতেই কেঁদে ফেলে এবং আত্মহত্যার চিন্তা ও প্রবণতা ও মরে যাওযার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। এ ছাড়া শারীরিক রোগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এরপরও মাথাব্যথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা করা, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জ্বালাপোড়ার অনুভূতি এবং যৌন আগ্রহ ও ক্ষমতা কমে যাওয়া।

মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, জিনেটিক বা বংশগত কারণে, অতীতে কোনো দুঃখ-বেদনা বা বিচ্ছেদের ঘটনায় বিষন্নতা সৃষ্টি হয়। দরিদ্র, গৃহহীন, ঋণগ্রস্ত ও ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বিষণ্নতা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। 

বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসা সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, মানসিক স্বাস্ব্যসেবায় মাত্র ২২০জন সাইকিয়াট্রিস্ট ও ৪৩ জন সাইকোলজিস্ট রয়েছেন। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক রয়েছেন ১০ হাজার। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স রয়েছে এক হাজার ৮৮১ জন এবং স্বাস্থ্যকর্মী ৭ হাজার ২৪৬ জন। আর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সরকারি শয্যা সংখ্যা ৮১৩টি। এ ছাড়া ৩১ টি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহ ও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগ, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহে চিকিৎসা নেওয়া যাবে।

মানসিক রোগের বিষয়ে জনসচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে বিষণ্নতার নির্ণয়ে অনেক সময় রোগীকে ১১ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীর সাথে কথা বলা ও মানসিক সমর্থন প্রদান করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, বিষণ্নতা গুপ্তঘাতকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ রোগ থেকে রক্ষায় সব সময় হাসিখুশি থাকতে হবে বা রাখতে হবে। ইদানিং নগরজীবনে ফ্লাটগুলোর এককেন্দ্রিক জীবনও বিষণ্নতা বাড়ায় বলে মনে করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিপার্শিক নানা কারণে বিষণ্নতায় ভোগেন মানুষ। এ রোগে মানুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। বিশ্বে প্রতিদিন ৩ হাজার মানুষ এবং বছরে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করছে বলে জানান তিনি।

অধ্যাপক ডা. অপূর্ব পন্ডিতের সভাপতিত্বে সেমিনারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাবেক এমপি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। এ ছাড়া অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. আবুল হাশেম খান বক্তব্য রাখেন।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেডটি/এনআই/এপ্রিল ০৭, ২০১৭)