প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ
শেয়ার কেলেঙ্কারিতে আসামিরা খালাস
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ মামলায় অভিযুক্ত র্যাংগস গ্রুপের কর্ণধার এম এ রউফ চৌধুরী ও এইচআরসি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাঈদ এইচ চৌধুরী বেকসুর খালাস পেয়েছেন। একইসঙ্গে অভিযোগ থেকে প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
রবিবার (২৩ এপ্রিল) শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক আকবর আলী শেখ এ রায় দিয়েছেন।
রায়ে বিচারক বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ১৯৬৯ অধ্যাদেশের ২৪ ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামি এম এ রউফ চৌধুরী, সাঈদ এইচ চৌধুরী ও কোম্পানি প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজকে এ মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হচ্ছে।’
এ দিন আসামি এম এ রউফ চৌধুরী, সাঈদ এইচ চৌধুরী, আসামি পক্ষের আইনজীবী শেখ বাহারুল ইসলাম, আব্দুস সালাম খান, আলহাজ্ব মো. বোরহান উদ্দিন ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা খান, আব্দুল্লাহ এম রফিকুল ইসলাম ট্রাইবুন্যালে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাঈদ এইচ চৌধুরী বলেছেন, ‘দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো কলঙ্ক ছিল না। আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। তবে ১৯৯৬ সালে কিছু দুষ্টু লোকের সাথে পরিচয় হয়। যা পরে বুঝতে পারি। যে কারণে মামলায় জড়াতে হয়েছে। অথচ প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে টাকাও ফেরত পাইনি। অন্যরা কোম্পানি বেনামে বিক্রয় করে টাকা আত্মসাৎ করে।’
কোনো অপরাধ না করেও অভিযুক্তদের হয়রানি হতে হয়েছে বলে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মন্তব্য করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী আলহাজ্ব মো. বোরহান উদ্দিন। তিনি মনে করেন, এতে সুনাম ও সময় উভয়ই নষ্ট হয়েছে। অথচ বিএসইসি সচেতনতার সাথে মামলা করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। বরং বিএসইসি ভালো কিছু ফল পেতে পারত।
প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা খান বলেছেন, ‘রায়ের কপি পাওয়ার পরে তা বিএসইসিতে দাখিল করা হবে। এর আলোকে উচ্চ-আদালতে আপিল করবে কিনা তা কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’
এ মামলার আসামিরা হলেন- প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজসহ প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এম এ রউফ চৌধুরী, পরিচালক সাঈদ এইচ চৌধুরী ও আনু জায়গীরদার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান। তবে এ মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে আসামি মশিউর রহমান ও আনু জায়গীরদারের বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। যা আগামী ২ মে পর্যন্ত কার্যকরী থাকছে। যে কারণে শুধুমাত্র প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ, এম এ রউফ চৌধুরী ও সাঈদ এইচ চৌধুরীকে নিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।
এই মামলায় মশিউর রহমান ও আনু জায়গীরদারের বিচারকাজে দুই দফায় ৬ মাস করে এক বছরের স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। প্রথমবার ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল এ বিচারকাজে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষে ২৯ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেন আদালত।
এর আগে চলতি বছর ১০ এপ্রিল বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ওইদিন আসামি পক্ষের আইনজীবী আলহাজ্ব মো. বোরহান উদ্দিন বলেছিলেন, ‘মামলায় দায়ের করা পিটিশন অসম্পূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। এ ছাড়া ক্রুটিপূর্ণ পিটিশন দায়ের করা হয়। যেখানে অভিযুক্তদেরকে দোষী হিসাবে সাব্যস্ত করার মতো কোনো প্রমাণাদি নাই।’
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, বিএসইসি কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত করালেও সে সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট জমা দেয়নি। রিপোর্ট নাকি হারিয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে এ রিপোর্ট হারিয়ে যায়! একইসঙ্গে অভিযুক্তরা শেয়ার কিনে লাভবান হয়েছে এবং কোনো বিনিয়োগকারী তাদের দ্ধারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। শুধুমাত্র বিএসইসির দুই কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন ও রুহুল কাদেরের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে এ মামলা দায়ের করা হয়। যে তদন্ত করা হয়েছিল তড়িঘড়ি করে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে দাবি করেন তিনি।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা খান ও আব্দুল্লাহ এম রফিকুল ইসলাম রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এ ক্ষেত্রে আসামিরা দোষী তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে তারা দাবি করেন।
যুক্তিতর্কে মাসুদ রানা বলেছেন, ‘যোগসাজোশের মাধ্যমে অভিযুক্তরা শেয়ারে কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
এর আগে ২১ মার্চ এ মামলার আসামি সাঈদ এইচ চৌধুরী সাফাই সাক্ষী প্রদান করেন। এ সময় তিনি কোনো অপরাধ করেননি এবং কোনো অপরাধের সাথে জড়িত নন বলে জানান। সততার সঙ্গে ব্যবসায় করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাফাই সাক্ষী প্রদানের পর বিএসইসির প্যানেল আইনজীবী মাসুদ রানা খান তাকে জেরা করেন।
অন্যদিকে ৮ মার্চ আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন এ মামলার আসামি এম এ রউফ চৌধুরী ও সাঈদ এইচ চৌধুরী। এদিন এম এ রউফ চৌধুরী আত্মপক্ষ সমর্থনের পাশাপাশি নিজেই সাফাই সাক্ষী প্রদান করেছিলেন।
এর আগে ১৮ জানুয়ারি এ মামলার ৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ডিএসই’র মহাব্যবস্থাপক রুহুল খালেক, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ দেলোয়ার হোসেন ও বিএসইসি’র সহকারী পরিচালক এনামুল হককে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেন। পরে ১ মার্চ অপর সাক্ষী মনিরউদ্দিন আহমেদকে জেরা করা হয়।
মামলা সূত্রে জানা যায়, আসামিরা প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের নামে ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। এ সময়ে তারা মিতা টেক্সটাইল, প্রাইম টেক্সটাইল, বাটা সুজ ও বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার লেনদেন করেন। প্রতিষ্ঠানটি ওই সময়ে মোট ১২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা লেনদেন করে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি শুধু ফরেন ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্টের (ডিভিপি) মাধ্যমে ৮৫ লাখ টাকা লেনদেন করে।
এ সময় এক নম্বর আসামি প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ ওই সময়ে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩টি শেয়ার বিক্রি করে, যার মূল্য ছিল ৬৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
স্টক এক্সচেঞ্জের রেকর্ড মোতাবেক আসামিরা এসিআই লিমিটেডের ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮১৯টি শেয়ার বিক্রি করেন। অথচ ব্যাংক রেকর্ড অনুযায়ী শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৮টি, যার মধ্যে ফরেন ডিভিপির মাধ্যমে লেনদেন অনিষ্পত্তি হওয়া শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
একইভাবে আসামিরা ডিভিপির মাধ্যম ছাড়াও স্থানীয়ভাবে শেয়ারের অন্যতম ক্রেতা-বিক্রেতা ছিলেন। আসামিরা ওই সময়ের মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মার ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৯৫টি শেয়ার বিক্রি করেন। এর মধ্যে ডিভিপির মাধ্যমে ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০টি শেয়ার বিক্রি করেন। আর এখানেও অনিষ্পত্তি হওয়া শেয়ার ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫০০টি। এ সব ফরেন ডিভিপির মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠানটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও ইন্দোসুয়েজ ব্যাংক ব্যবহার করত। আসামিদের এ ধরনের কার্যকলাপ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি, অপকার ও অনিষ্ট করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ-১৯৬৯ এর ২১ ধারা বলে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে আসামিরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ-১৯৬৯ এর ১৭ ধারার ই (২) বিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। আর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ২৪ ধারার অধীনে আসামিদের শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
(দ্য রিপোর্ট/আরএ/জেডটি/এপ্রিল ২৩, ২০১৭)