বরিশাল প্রতিনিধি : আজ সেই ভয়াল ২৫ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এদিন সকাল ১০টায় বরিশালে জল, স্থল ও আকাশ পথে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানী সেনারা। শিশু, নারী, বৃদ্ধা ও যুবা মিলিয়ে ৪৭ জনকে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে শহরতলীর চরবাড়িয়া এলাকায়। আজও সেদিনের স্মৃতি বুকে বয়ে নিয়ে গুমরে কাঁদেন সেই শহীদদের স্বজনেরা।

ওই এলাকার জিন্নাত মুন্সী (৬৬) পাকিস্তানীদের সেদিনের ‘নরহত্যা’র প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী আসবে বলে নদী পাড়ের চরবাড়িয়া গ্রামের কোনো কোনো বাড়ির বাসিন্দারা মাটি খুড়ে ট্রেঞ্চ তৈরি করেছিলেন নিরাপত্তার জন্য। ২৫ এপ্রিল সকাল ১০টা নাগাদ গানবোট যোগে পাকিস্তানি সেনারা ঝুনাহার নদীতে পৌঁছলে ক্যাপ্টেন মেহেদির নেতৃত্বে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়ে। প্রতিরোধের জন্য ইরানি ও মাজদি নামক দুটি জাহাজ নদীর পাড়ে রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানী সেনারা প্রথমে জাহাজ দুটি ধ্বংস করে তালতলী নদী হয়ে সামনের দিকে আসতে থাকে। ভারি অস্ত্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে রণ কৌশল পরিবর্তন করে পিছু হটে। গানবোট এসে ভিড়ে বড় হাওলাদার বাড়ির ঘাটে। এই বাড়িতে নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে হত্যা আর অগ্নিসংযোগ করে চারদিক ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনারা। মান্নান হাওলাদার বাড়িতে একত্রে হত্যা করে ৮ জনকে। সব মিলিয়ে যার সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ৪৭ জনে। এ সময় হেলিকপ্টারে করে সেনা নামানো হয়। হত্যাযজ্ঞ শেষে সাপনিয়া হয়ে ছাদ দেয়ালওয়ালা (প্রাচীর ঘেরা) বাড়িতে আগুন লাগিয়ে বরিশাল নগরীর পানে রওয়ানা হয় পাকিস্তানি সেনারা। নগরীর ত্রিশ গোডাউনে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেয় ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হওয়া পর্যন্ত।’

বড় হাওলাদার বাড়ির গৃহবধূ আমিরুন্নেছা বেগম জানিয়েছেন, তাদের বাড়ির দরজায় বটগাছে পাকিস্তানী সেনাদের গানবোট বাঁধে। এরপর গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। ওই স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি ফিরে যান ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিলের ঘটনার দিনে। তার বড় জায়ের ছেলে বাচ্চু তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। লাগোয়া বাড়ির মান্নান উকিলের মা বাচ্চুকে ডেকেছিলেন মরিচ তোলার জন্য। বৈশাখ মাসের দিন ১৬ তারিখ। মরিচ তোলা শেষে একটি গাছের মগডালে উঠে বাচ্চু কবিতা আওড়ায়-‘শাসন করলি শোষণ করলি/মরল মোদের বাঙ্গালি/করলি মায়ের বুক খালি’। সে সময়েই বাচ্চুর মা চানবরু বেগম গানবোট আসার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে বাচ্চুকে ডেকে বাড়ির পাশে তৈরি করা ট্রেঞ্চে ডেকে নেন। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাদের নির্মম বুলেটে বাচ্চু ও তার মা, চাচি রহিমা বেগমসহ ৫ জন নিহত হন। একই বাড়ির জালাল ডাক্তার ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে পাকবাহিনী। সে সময় প্রেসে চাকরি করা ওহাব হাওলাদার নতুন পুকুর কাটলে, ওই পুকুরেই তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানী সেনারা। তিন দিন পর বাড়ি ফিরে তারা দেখেন গুলিবিদ্ধ লাশ ফুলে ঢাউস হয়েছে। ওই দেখে আমিরুন্নেছা বেগমের স্বামী মালেক হাওলাদার তার জীবদ্দশায় কখনো মাছ খেতে পারেননি।

পাশের গ্রাম সাপনিয়া প্রাচীর ঘেরা বাড়িটি ছিল ধনে-মানে সমৃদ্ধ। এই বাড়ির কাচারিতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকেন এমন সংবাদ পেয়ে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানী সেনারা আগুন লাগায়। বাড়ির ৯টি ঘর পুড়তে ৭ দিন লেগেছিল বলে জানান এই বাড়ির হাবিবুর রহমান হাওলাদার।

আরেক বাসিন্দা ইউনুচ আকন জানিয়েছেন, সেদিন তাদের বাড়ি পোড়ানোর আগে কাজের লোক ইজ্জত আলীকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী সেনারা। তাদের এক চাচাকে পেয়ে আক্রমণ করতে চাইলে তিনি ওজু করতে এসেছেন নামাজ পড়বেন এই বলে প্রাণে বাঁচেন। বর্ধিষ্ণু এই পরিবারের ঘর পোড়ার পর, পোড়া চাল ও ডাল আর আলু সেদ্ধ করে জীবন রক্ষা করেছেন বলে জানালেন ছালাম আকন। মুক্তিযুদ্ধে বাড়ি পোড়ানোর পর তাদের সামনের অংশের কিছুটা দেয়াল তুলতে পারলেও পুরো বাড়ির চতুর্দিকে আজ অবধি দেয়াল ফেরাতে পারেননি অর্থাভাবে। অমনি করে চরবাড়িয়া এলাকার প্রেসে চাকরি করা ওহাব হাওলাদারকে হত্যার পর অসহায় হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পার হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পরিবারটি। পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটে ঝাঁঝরা করা টিনের চালা দিয়ে বৃষ্টিতে জল গড়ালেও নতুন করে ঘর নির্মাণ করতে পারেননি বলে জানালেন নিহত ওহাব হাওলাদারের বড় পুত্রবধূ পারুল বেগম।

কোনো সহায়তা না পেয়ে অবশেষে নিজেদের উদ্যোগে চরবাড়িয়া গণহত্যার স্মৃতি তুলে ধরতে তালতলি বাজারে একটি স্মৃতি ফলক তৈরি করেছেন বলে জানান স্বজনহারা পরিবারের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মন্নান।

তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘মো. শহীদুল আলম জেলা প্রশাসক থাকাকালিন সময়ে তালতলি নদী বুকে জেগে ওঠা চরে এক একর জমি দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিলেন সেখানে একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য। যার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বরিশাল আক্রমণের দিনে পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার কাহিনী। তবে দেড় বছর হলো ওই প্রকল্পের কোন অগ্রগতি নেই বলে বিরক্তি প্রকাশ করেন ওই এলাকার বাসিন্দা ও নগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিট কমান্ডার মোখলেচুর রহমান।

(দ্য রিপোর্ট/এমএইচএ/জেডটি/এনআই/এপ্রিল ২৪, ২০১৭)