তামাকজাত দ্রব্যের চোরাচালান ও কর বৃদ্ধি
ইকবাল মাসুদ
বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ (২ কোটি ১৯ লাখ) ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করে এবং ২৭.২ শতাংশ (২ কোটি ৫৯ লাখ) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার নারীদের মধ্যে অনেক বেশি। বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তামাকপণ্য ব্যবহার করে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই তামাক সেবনের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাজনিত রোগে মারা যায় ৫৭.০০০ মানুষ আর পঙ্গুত্ববরণ করে ৩,৮২,০০০ মানুষ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০০৪), আর্থিক ক্ষতি হয় বছরে দশ হাজার কোটি টাকারও অধিক। আন্তর্জাতিকভাবে সিগারেট ব্যবসার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (প্রতি বছর ৩৫০ বিলিয়ন) অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বা চোরাচালানের মাধ্যমে বিক্রি হয়। এর ফলে সিগারেটের মূল্য কমে যায় এবং চাহিদা বাড়ে। পরিণতিতে তামাকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, তামাক কোম্পানিগুলো নিজেরাই বর্তমান এই চোরাচালানের সুবিধা নিচ্ছে। তামাক চোরাচালান সুসংগঠিত অপরাধ অর্থপাচার এবং অবৈধভাবে অর্থোপার্জনের সাথেও সম্পৃক্ত। ফিলিপ মরিস (মালবোরো ব্রান্ড কোম্পানী) ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি উভয়ই ল্যাটিন আমেরিকায় তামাক কালোবাজারির সাথে জড়িত থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থোপার্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
১৯৯৭ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চোরাচালান বিষয়ে অনেকগুলো মামলা হযেছে এবং তদন্ত হয়েছে যেখানে কোম্পানিগুলোকে চোরাচালানকৃত সিগারেটের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে জানার এবং সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির একজন কর্মকর্তাকে চীনে সিগারেট চোরাচালানে ভূমিকা রাখার জন্য হংকংয়ের উচ্চ আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করেছে। RJ Renold কোম্পানি আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত অবৈধভাবে অন্য পথে কানাডাতে সিগারেট প্রেরণ করার ব্যাপারে চোরাচালানকারীদের সহযোগিতা করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এটি এখন পরিষ্কার, অনেক সরকারই এখন এটি অনুধাবন করে যে, তামাক কোম্পানিগুলোর চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ততার জন্য তাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডা, কম্বোডিয়ান গভর্নর, ইকুয়েডর, ইউরোপিয়ান কমিশন এবং ৯ সদস্য বিশিষ্ট ইউরোপিয়ান দেশগুলো ইটালি, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল ও গ্রিস হন্ডুরাস এবং বেলিজ আন্তর্জাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর চোরাচালানের বিরুদ্ধে আইনি মামলা করেছে অথবা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তামাক ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনার বিভিন্ন পন্থার মধ্যে অন্যতম একটি যথোপযুক্ত উপায় হলো তামাকজাত সামগ্রীর উপর অধিকহারে কর আরোপ করা। তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত কর বৃদ্ধির বিষয়টিকে বিরোধিতা করে থাকে। তারা বরাবরই একটি যুক্তিতে বিশ্বাস করে যে, অধিকহারে কর বৃদ্ধির বিষযটি তামাকজাতদ্রব্যের চোরাচালান বৃদ্ধিতে আরও উৎসাহ যোগায়। এছাড়া তামাক কোম্পানি বারবার প্রমাণের চেষ্টা করে যে, কর বৃদ্ধি তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন কার্যকরী পন্থা নয়। করের জন্য চোরাচালান সংঘটিত হচ্ছে সেজন্য চোরাচালানে বিরোধিতা করায় কর কমানো দরকার। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য অনুসারে দেখা যায়, শুধু কর বৃদ্ধির কারণে চোরাচালান সংগঠিত হয় না। বিশ্বের অনেক দেশে অধিকহারে কর বৃদ্ধি করলেও চোরাচালান বৃদ্ধি পায়নি। আবার অনেক দেশ আছে যেখানে কম আরোপ করা হয় কিন্তু সেখানে ব্যাপক চোরাচালান হয়েছে।
তামাকের মূল্যহ্রাসের কারণে তামাক কোম্পানিসমূহ উপকৃত হয়, চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং যারা ধূমপান ত্যাগ করতো তারা কালোবাজারের সস্তা সিগারেট ধূমপান করতে থাকে। তামাক কোম্পানির প্ররোচনায় সরকার তামাকের কম কর নির্ধারণ করে বিধায় বৈধ বাজারে সিগারেটের মূল্য কমে ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে তামাক কোম্পানিগুলো এর সুফল ভোগ করে।
বাংলাদেশেও সংঘবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্র অত্যন্ত সক্রিয়। তামাকজাতদ্রব্যের চোরাচালানের উপর সামগ্রিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্ এর গবেষণায় অনুসারে দেখা যায় (Illegal pathways to Illegal profits– The big cigarette companies and International smuggling ) ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বাংলাদেশে তামাক চোরাচালানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং তাদের তত্ত্বাবধানে ভারত বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে চোরাচালান সংগঠিত হয়।
একটি পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, দেশের ব্যবহৃত সিগারেটের ৩০% চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সিগারেট। সরেজমিনে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একাধিক জায়গায় অবাধে বিদেশি সিগারেট বিক্রি হচ্ছে যা চোরাচালানের মাধ্যমে এদেশে প্রবেশ করেছে। এরকম কয়েকটি স্থান হলো নীলক্ষেত, এলিফ্যান্ট রোড, গুলশান-১, গুলশান-২, বারিধারা, শ্যামলী, নিউমার্কেট, শাহবাগ, উত্তরা ইত্যাদি। বিভাগীয় পর্যায়েও চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সিগারেট, চুরুট ও অন্যান্য তামাকজাত সামগ্রী অবাধে বিক্রি হচ্ছে। যে সকল ব্র্যান্ড খুবই সহজলভ্য তাহলো- Surya, Panama (Indonesia), Dunhill, Maiwand (UK), Lips Cherry Cigars (Netherlands), Marlboro (Switzerland), ORIS, Pine, Gurleen, Esse Lits (Korea), Imperial, Steel, Captain Black, More, Cafe Creme, Winston (U.S.A) ইত্যাদি। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে এখানে একাধিক ব্র্যান্ডের সিগারেট উঁঃু ঋৎবব ঝধষব এর জন্য আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু তামাক কোম্পনী গুলো সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে খোলা বাজারে খুচরা বিক্রি করছে আবার অন্য দেশের Duty Free Sale এর জন্য প্রস্তুত করা সিগারেট বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য।
বাজেটকে সামনে রেখে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিবছর সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্নভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি এবারও প্রি-বাজেট সভায় এনবিআর তামাক কোম্পানির সাথে আলোচনা করেছে। আমরা জেনেছি বিভিন্ন তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী তামাক কোম্পানির সাথে সরকারের বৈঠক না করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা মান্য হয় না। এছাড়া অতীতে আমরা দেখেছি কোম্পানিগুলো তাদের দাবির পক্ষে এমপিদের কাছ থেকে ডিও লেটার সংগ্রহ করে। গত বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন- ‘বিশ্বব্যাপী ধূমপানবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান, তামাকজাত পণ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকিহেতু এর ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং রাজেস্ব আয় বৃদ্ধি এ খাতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
তামাক ব্যবহারের ক্ষতি ও সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে প্রতিবছর তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে; যাতে তামাকপণ্য ক্রমশ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এছাড়া আগামী বাজেট ২০১৭-১৮ এর জন্য আমার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ হচ্ছে: সিগারেটের মূল্যস্তরভিত্তিক কর-প্রথা বাতিল করে প্যাকেট প্রতি খুচরা মূল্যের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ পরিমাণ সম্পূরক কর নির্ধারণ করতে হবে। বিড়ির ট্যারিফ ভ্যালু তুলে দিয়ে প্যাকেট প্রতি খুচরা মূল্যের ৪০ শতাংশ পরিমাণ সম্পূরক কর নির্ধারণ করতে হবে। গুল-জর্দার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পরিমাণ সম্পূরক কর নির্ধারণ করতে হবে। তামাকের ওপর আরোপিত স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। অবিলম্বে তামাকের বিদ্যমান শুল্ক-কাঠামোর পরিবর্তে কার্যকর তামাক শুল্কনীতি প্রণয়ন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : প্রধান কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন