‘শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালের বেহাল দশা’
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের বেহাল দশার কথা শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর কাছে তুলে ধরলেন বিচারক ও আইনজীবীরা। এ সময় তারা শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল একই ভবনে স্থাপন ও শ্রম আইনের সংশোধনীসহ বেশ কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন।
রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে শ্রম ভবনে সোমবার বিকেলে লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বিচারক ও আইনজীবীরা তাদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুল হক বলেন, ‘লেবার কোর্টের কাজ হলো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা। কিন্তু তা হচ্ছে না। মামলার জট দেখা দিয়েছে। অনেক সময় ২-৩ মাস পর পর মামলার তারিখ পড়ে। এতে বাদী ও বিবাদী উভয়কেই সমস্যায় পড়তে হয়।’ এ জন্য তিনি ঢাকায় দু’টিসহ আরও তিনটি শ্রম আদালত স্থাপনের দাবি জানান।
অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুদ্দৌজা বলেন, ‘আদালতে যে পরিবেশ দরকার, তার খুবই অভাব। এজলাশ কক্ষ এতো ছোট যে আইনজীবীদের দাঁড়ানোরই জায়গা হয় না। টয়লেট থেকে গন্ধ আসে। পানিও মাঝে মাঝে থাকে না।’
অ্যাসোসিয়েশনের আরেক সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট নেসার আহমেদ বলেন, ‘আইনে আছে প্রয়োজনের অধিক শ্রম আদালত স্থাপন করা যাবে। এটা এখন দেখার বিষয় যে কীভাবে মানুষকে দ্রুত সেবা দেওয়া যায়।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘শ্রম আদালতে চাকরি নেওয়ার পর থেকে(কর্মকর্তারা) তারা একই জায়গায় বছরের পর বছর থাকেন। এতে সমস্যা হয়।’ বিষয়টি সমাধানের জন্য মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘যখন শ্রম আদালত শুরু হয়, তখন ঢাকা ও আশপাশে ১০-১৫টা কলকারখানাও ছিল না। গত ২০ বছর ধরে তিনিটি আদালতে বিচার চলছে। এ সময়ে ব্যাপক হারে কলকারখানা বেড়েছে। দেখা যায়, আমাদের ইন্সপেক্টররা কোনো জেলায় গেলে ১০০-২০০ মামলা নিয়ে আসেন। আমি ২০০-২৫০টা মামলার সমাধান করি। এরপরেও কিন্তু মামলা শেষ হচ্ছে না।’
মামলা জটের কারণ হিসেবে বলেন, ‘অনেক সময় আদালতের কোনো সদস্য অনুপস্থিত থাকলে বিচার কাজ স্থগিত হয়ে যায়। এ ছাড়া মালিকপক্ষ থেকে মামলা ধীরগতি করতে নানা পিটিশন দায়ের করে। অনেক সময় বাদী পক্ষকেও পাওয়া যায় না।’
শ্রম আদালতের অবকাঠামোগত নানা দুর্বলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এজলাসে ১০-১২ জনের বেশি বসা যায় না। অনেক সময় হাজার হাজার শ্রমিক মামলার কারণে একসঙ্গে আদালতে আসেন। তাদের চেঁচামেচিতে ঠিকমতো সাক্ষ্যগ্রহণ করা যায় না। আমি একটি ভাঙ্গা গাড়িতে করে যাতায়াত করি। রাস্তার মধ্যে নেমে ধাক্কাতে হয়। আগুন জ্বলে ওঠে। অনেক সময় হেঁটেই বাসা বা অফিসে আসতে হয়।’
প্রথম শ্রম আদালতের বিচারক মিয়া মো. শরীফ বলেন, ‘শ্রম আদালতে দিনের পর দিন মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সাভার ট্রাজেডির পর এ হার আরও বেড়েছে। শ্রম ভবনটা লেবার কোর্টের জন্য উপযোগী নয়। লেবার কোর্ট ও লেবার আপিল ট্রাইব্যুনাল একই কমপ্লেক্সে করা উচিত।’
দ্বিতীয় শ্রম আদালতের বিচারক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ ভবনে তিনটি শ্রম আদালত রয়েছে। এখানে তিনজন জেলা জজ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এজলাসে প্রয়োজনীয় চেয়ার নেই, খাস কামরায় এসি নেই। অথচ আমরা সচিব মযাদায় আছি। কিন্তু উপ-সচিবদের রুমেও এসির ব্যবস্থা আছে। এ অবস্থায় গ্রীষ্মকালে আদালতে বিচার কাজ করা খুব কষ্টকর হয়ে উঠে।’
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য নুরুন নাহার ওসমানী বলেন, ‘শ্রম আদালতের চেয়েও বেশি সমস্যা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে। এখানকার অবস্থা আরও শোচনীয়।’
শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল একই ভবনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে সবার জন্যই ভাল হবে।’
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, ‘শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ২০১১ সালে অর্গানোগ্রাম হয়েছে কিন্তু আজও তা অনুমোদিত হয়নি। ২০০৩ সালে শ্রম আইন হয়েছে। এতে চেয়ারম্যান বা অন্যদের বেতন কাঠামো নেই। আমি যে বেতন পাই সেটাই তো বেআইনি। আমি যে গাড়িতে চড়ি তা মাঝপথে তিন বার ধাক্কাতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে আমরা যে রায় দেই বিবাদীরা হাইকোর্টে গিয়ে রিট করে তা ৫ বছর স্থগিত করে রাখে। এই হলো অবস্থা। লেবার আপিল ট্রাইব্যুনালের যদি ক্ষমতা না থাকে তাহলে আাপনারাও (উপস্থিত আইনজীবীসহ সবাই) জিরো। এতে গরীব মানুষের ওপর খড়গ নেমে আসে। বিষয়টি লিখিতভাবে আইন মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।’
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর উদ্দেশ্যে বিচারপতি শামসুল হুদা আরও বলেন, ‘আমি যে বিল্ডিংয়ে (শ্রম আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ভবন) আছি তার বয়স ৯৭ বছর। মন্ত্রী মহোদয়-আপনি সেখানে গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না। গেলেও আর গাড়ি বের হবে না। অথচ কর ন্যায়পাল ভবন অলস পড়ে আছে। সেখানে আমাদের দিলেই হয়। এটি আমরা চেয়েছিলাম,কিন্তু দেওয়া হয়নি।’
জবাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু শ্রম আদালত ও শ্রম আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাই তখন পরিচিত অনেকেই বলেছেন এটি কোনো মন্ত্রণালয় হলো। এলাকার লোকজন বলেছে এমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন যার নামই আমরা শুনিনি। শ্রম মন্ত্রণালয়টি বরাবরই অবহেলিত। তবে এখন এ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে।’
শ্রম আইন ২০০৬ এর কিছু পরিবর্তনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু দিনের মধ্যেই একটি শ্রম বিধি পাবেন।’
এ সময় উপস্থিত আইনজীবীরা বিধি ফাইনাল করার আগে খসড়া দেখার জন্য কপি চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আইনজীবী, শ্রমিক নেতা ও মালিকপক্ষের মতামত নিয়েই এটি করা হচ্ছে।’
পরে আইনজীবীদের চাপাচাপির কারণে একটি খসড়া তাদের দেওয়ার কথা জানান প্রতিমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বিচারক ও আইনজীবীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে এটা তো(শ্রম আদালত) অফিস বিল্ডিং। পুরানাপল্টনে ১৫তলা কমপ্লেক্স হবে। আগামী বাজেটেই অর্থ পাস হবে। ৩-৪ বছরের মধ্যেই ভবনটি হয়ে যাবে। কোর্টের আদলেই সেখানে সব হবে।’
তিনি বলেন, ‘আরও তিনটি শ্রম আদালতের অনুমতি হয়েছে। এগুলো আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যেই স্থাপন করা সম্ভব হবে।’ এ ছাড়া মানুসের হয়রানি বন্ধ এবং জেলা পযায়ে কীভাবে শ্রমিকদের সেবা দেওয়া যায় এজন্য সবার কাছে পরামর্শ চান তিনি।
লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি চৌধুরী সানাওর আলীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বারের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন, শ্রমিক নেতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইলসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এনডিএস/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪)