মাকে ভালোবাসার জন্য কি বিশেষ দিবসের প্রয়োজন আছে? কেউ কেউ হয়তো বলেবেন প্রয়োজন নেই। মায়ের জন্য ভালোবাসা প্রতিদিনের। তবুও প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার উদযাপন করা বিশ্ব মা দিবস। এদিনে অনেকে তাদের মাকে জানান ভালোবাসার কথা। কবি, নাট্যকার, নির্দেশক ও মণিপুরি থিয়েটারের সভাপতি শুভাশিস সিনহা লিখেছেন তার মাকে নিয়ে। দ্য রিপোর্ট পাঠকদের জন্য সেটা প্রকাশ করা হলো।

 

সবার মায়ের মতো আমার মা-ও তার সন্তানদের জন্য সদাব্যাকুল এক নারী। আমরা তিন ভাই বোন (শিশির, শর্মিলা আর আমি)। আমাদেরকে স্বাধীনতার এক অসীম আকাশ দিয়েছে মা, অগাধ সমুদ্র। এ জীবনে কতো যে যন্ত্রণা দিয়েছি মাকে। তবু তো এক বিন্দু কমতি নেই মায়ের ভালোবাসার। আমাদের যে কোনো সিদ্ধান্তের ওপর, কাজের ওপর মায়ের অটল ভরসা। কখনো তা যদি নাও থাকে, মা তবু নিজের ভালোবাসার, মমতার জোরে সব মেনে নেয়। শুধু সন্তানই নয়, সন্তানদের বন্ধু-প্রিয়জনদেরকেও নিজের অন্তরের আপন করে নেয় মা সহজেই, তাদের যে কোনো ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিতে পারে লহমায়, সন্তানদের মতোই। কখনোই মা তার চিন্তা কি ভাবনার ভার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় নি। মনেপ্রাণে সে আধুনিক। দিদির মতো আমিও এখনো চিরায়ত সামাজিক দায় মেটাতে পারি নি, যা যেকোনো বাবা-মায়ের কাম্য। কিন্তু তাতে মায়ের কখনো-বা যদিও চিন্তা আসে মনে, পরক্ষণেই ঝটিকায় তা সরিয়ে দিয়ে হাসি-আনন্দে জড়িয়ে যেতে পারে আমাদের কল্পনাময় যাপিত জীবনে। সুখ কিবা শান্তির আপেক্ষিকতাকে মা যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেনে!

আমার মা ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। কিন্তু শিক্ষিত। পাকিস্তান আমলে, আমাদের এলাকায় সার্বিক শিক্ষার হারও ছিল খুবই কম, আর শিক্ষিত মেয়ে/নারীর সংখ্যাও হাতে গোনা যাবে এমন। মণিপুরি সমাজের কথা তো বলাই বাহুল্য। মা সেই সময়ে, অভাব-অনটনের মধ্যে, দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পড়ালেখা করে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন। শুধু পাশ নয়, মাত্র পাঁচ নাম্বারের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন পায় নি। মেট্রিকেও সেরকমই রেজাল্ট।

বাবার মতো মাও খুব পড়ুয়া। কোনো উপদেশ দিতে গেলে মা প্রায়সময়ই সংস্কৃত শ্লোক শোনায়। ছোটবেলায় মা’র মুখে কতো যে ছড়া শুনেছি। মা’র সবচেয়ে প্রিয় কবিতা রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’। ভরাট আবেদনময় কন্ঠে মা এখনো মাঝেমধ্যে যখন ‘সোনার তরী’ শোনায়, গগনে মেঘ যেন সত্যি গরজে ওঠে। আর মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়’ কিংবা রজনীকান্তের ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ গানটা যখন মা নিজের মনে গায়, রান্নাঘর থেকে তার গলা শোনা যায়, চোখে পানি আসে। এমন দরদী গলা!

সেই শরৎ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আমার সমসময়ের বন্ধুদের লেখাও হাতে দিলে মা পড়তে বসে যায়। আর আমার লেখার তো কথাই নেই। আমার যে-কোনো লেখার প্রথম তিন চারজন পাঠকের মধ্যে মা একজন। আমার পুরো থিয়েটারটির মা তো আমার মা-ই। একটা বাড়িতে এত ঝঞ্ঝাট, হুলস্থূল সব সে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। নতুন নাটকের মহড়া শুরু হলে মায়ের মনে খুব খুশি। তোড়জোর করে কাজ শেষ করেই চুপচাপ গিয়ে বসে পড়বে নটমণ্ডপের এক কোণে। চুপচাপ দেখবে। অনেকটা সময় মা নিজেই সবসময় আমাদের চা করে দিয়েছে, খাইয়েছে। আর নিজের ভিটার ওপর গড়া নটমণ্ডপ, সেই অধিকারেও মা কোনোদিন চেয়ারে বসে নাটক দেখে নি, কখনো বসলেও একদম পেছনের সারিতে। সবসময়ই মাটিতে পাড়ার সব মহিলার সাথে বসে আমাদের নাটক দেখে মা। সারাটা জীবন নিজেকে আড়াল করেই রাখল।

মা আমার প্রাণময়ী। সংসারের মধ্যে থেকেও গ্রামের এক প্রান্তে এক সন্তান-বৎসল গৃহিণীমাত্র হয়েও মা যে অন্তরের দরজা-জানালা সেই সুদূর কিবা গহনের জন্য সবসময় খোলা রেখেছে। নিত্যকার বস্তজীবনের বাইরেও ভাবনার এক জগৎ আছে তার, আমরা জানি। তাই মাত্র গত তিন বছরে একের পর এক প্রিয়জন হারিয়েও মা নিত্যকার সঙ্গী অশ্রু আর বেদনার পথ থেকে ঝটিকায় সরে এসে বসে যেতে পারে আমাদের গল্পে, গানে, আড্ডায়।

বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে মা এতটাই ভেঙে পড়েছিল, আমরা শঙ্কায় থাকতাম। তার এক বছর পর দিদিমার মৃত্যু। পরে পরেই আমার একমাত্র কাকার মৃত্যু। আরও কতো নিকটাত্মীয়ের যে মৃত্যু হলো এই তিন বছরে। যেন মৃত্যুর মিছিল। মৃত্যু নিয়ে যে মা সবসময একটা চরম ভাবাবেগে থাকে, সংবেদনশীল যে এত, সে সবকিছুকে অতিক্রম করতে পারল শুধু আমাদের মুখের দিকে চেয়ে, আমাদের কথা ভেবে। আর সংসার বন্ধনের বাইরে পৃথিবীর ভাবনার এক আপন জগতের জোরেও।

আমার কিশোরী কিবা তরুণী মা কল্পনায় আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর নারী। সুন্দরীই তো! কোঁকড়া চুল, গভীর চোখের সেই মায়ের প্রেমেই তো পড়েছিল আমার বাবা। তাই মারাও গেল, অকস্মাৎ, ট্রেনে করে প্রিয় সঙ্গিনীর সাথে ভ্রমণে।

আমার মা আমার ভালোবাসার দেশ। তার মধ্য দিয়েই আমি দেশ বুঝি। ভালোবাসা বুঝি। জীবন যে কী মায়াময়, বুঝি।

বুঝি বলেই আর সরে যেতে পারি না নিজের মাটির থেকে, ছিন্ন হতে পারি না শিকড়ের থেকে। আমার শিল্প এই বোঝাপড়ার অতলান্ত রসায়ন।

এ জীবনে লোভনীয় কতো আহ্বান এসেছে হাতছানি এসেছে বাইরের, ফিরিয়ে দিয়েছি স-ব। এখনো মায়ের সাথে বসে সন্ধ্যার চা না খেলে, ভাত খেতে না বসলে যে মনে হয়, কী যেন মিস হয়ে গেল আজ!

না, মিস হতে দেয়া যাবে না!

আছি, মা!

লেখক : শুভাশিস সিনহা

কবি, নাট্যকার, নির্দেশক ও সভাপতি, মণিপুরি থিয়েটার

(দ্য রিপোর্ট/পিএস/মে ১৪, ২০১৭)