ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে সুহৃদ ইন্ডাষ্ট্রিজ। তবে সম্প্রসারণের পরিবর্তে সংকুচিত হয়ে এসেছে কোম্পানির ব্যবসা। ধারাবাহিকভাবে কমছে বিক্রয়ের পরিমাণ। একইসঙ্গে গুণতে হচ্ছে লোকসান। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগে ধারাবাহিকভাবে বিক্রয় ও মুনাফা বেড়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ.বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে অনেক কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) এক দুই বছর আগে থেকে কৃত্রিমভাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখায়। এই ধরনের প্রবণতা বন্ধে ৫ থেকে ১০ বছরের আর্থিক হিসাব পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

দেখা গেছে, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৪ লাখ টাকার বিক্রয় করে। যা পরবর্তীতে ৫ অর্থবছরে যথাক্রমে হয় ১৪ কোটি ১৬ লাখ, ১৮ কোটি ৯৭ লাখ, ২০ কোটি ২৩ লাখ, ২২ কোটি ৯৯ লাখ ও ২৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। এ সময় যথাক্রমে মুনাফা হয় ১৯ লাখ, ২৫ লাখ, ৩ কোটি ৭৭ লাখ, ২ কোটি ৮৮ লাখ, ৩ কোটি ৪২ লাখ ও ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

এদিকে কোম্পানিটি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির বছরেই বিক্রয় কমে যায় ৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বা ৩৯ শতাংশ। এ বছর বিক্রয় হয় ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও কমে বিক্রয় হয় ১১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। যা চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে হয়েছে ৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার।

এদিকে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা মুনাফা করে। তবে তালিকাভুক্তির ২০১৪-১৫ অর্থবছরেই ১৭ লাখ টাকা লোকসান করে। এই লোকসানের পরিমাণ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও বেড়ে হয় ২২ লাখ টাকা। যা চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে এরইমধ্যে ৪৩ লাখ টাকা লোকসান হয়ে গেছে।

২০১৩ সালের ৩০ জুনে কোম্পানির ৩১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার শেয়ার ক্যাপিটালসহ ৪৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার ইক্যুইটি ছিল। আর এই মূলধন দিয়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার বিক্রয় করে। অপরদিকে শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ ও বোনাস শেয়ার দিয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুনে ৫২ কোটি ১৫ লাখ টাকার শেয়ার ক্যাপিটালসহ ইক্যুইটি দাড়ায় ৬৩ কোটি টাকা দাঁড়ায়। আর ইক্যুইটি ব্যবহারে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১ কোটি ৮১ লাখ টাকার বিক্রয় হয়। অর্থাৎ কোম্পানির ইক্যুইটি বেড়ে দ্বিগুণ হলেও বিক্রয় নেমে এসেছে অর্ধেকে।

এদিকে চলতি অর্থবছরে সুহৃদের লোকসানের পাশাপাশি গরমিল আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম ২ প্রান্তিকে বিক্রয় ও ব্যয়ের তথ্য প্রদান করলেও তৃতীয় প্রান্তিকে তা করেনি। শুধুমাত্র শেয়ারপ্রতি লোকসানের পরিমাণ দেওয়া হয়েছে। যাতে শেষ প্রান্তিকের সঠিক আর্থিক অবস্থা বোঝা যায়নি এবং সত্যতা পাওয়া যায়নি। যাতে কোম্পানির প্রদত্ত আর্থিক হিসাবকে ভুল হিসাবে ডিএসই কর্তৃপক্ষ লাল চিহ্নিত করে রেখেছেন।

কোম্পানির আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে লভ্যাংশেও নাজুক অবস্থা। তালিকাভুক্তির ৩ বছর মাত্র ১ বার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সেটাও বোনাস শেয়ার। কোম্পানিটি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ব্যবসায় ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল। এরপরে কোন লভ্যাংশ না দেওয়ায় কোম্পানিটি সর্বনিম্ন ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পতিত হয়।

ব্যবসায়িক মন্দাবস্থায় কোম্পানির শেয়ার দরেও নাজুক অবস্থা। ২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে আসে। এরপরে বর্তমান সময় পর্যন্ত শেয়ারটি কয়েকবার অভিহিত মূল্যের উপরে গেলেও তা স্থায়ী হয়নি। যা চলতি বছরের ৯ মে লেনদেন শেষেও অভিহিত মূল্য ১০ টাকার নিচে ৯.১ টাকায় অবস্থান করছে।

প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, আইপিও পরবর্তীতে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ ছিল ৩২.৬২ শতাংশ। যা চলতি বছরের ৩১ মার্চ কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৪১ শতাংশে। বাকি ৯০.৫৯ শতাংশই রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। অর্থাৎ কোম্পানির উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা তাদের শেয়ার বিক্রয় করে বেরিয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান লোকসান ও বেহাল অবস্থায় থাকলেও উদ্যোক্তাদের উল্লেখ করার মতো কোন ক্ষতি হবে না। আর শেয়ার ধারণের এই শোচনীয় পরিস্থিতির কারণে কোম্পানিটি এরইমধ্যে রাইট শেয়ার ও পূনঃগণপ্রস্তাবের (আরপিও) মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের যোগ্যতা হারিয়েছে।

করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইনস (সিজিজি) অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ন্যূনতম ৫জন পরিচালক রাখার নিয়ম রয়েছে। এবং এক-পঞ্চামাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখতে হয়। তবে সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজে শুধুমাত্র ৩জন পরিচালক রয়েছেন। তবে কোন স্বতন্ত্র পরিচালক নাই। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিতে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. আনিস আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে জাহেদুল হক ও পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সায়েদা সায়মা আক্তার।

কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) জিয়াউর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আগের জেনারেটর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এ সমস্যার তৈরি হয়েছে। তবে অতি শিগগিরই এ সমস্যা কেটে যাবে।

কোম্পানিটি ১ কোটি ৪০ লাখ শেয়ার ছেড়ে ১০ টাকা মূল্যে ১৪ কোটি টাকা উত্তোলন করে। যে অর্থের ৪ কোটি ৩৭ লাখ দিয়ে ঋণ পরিশোধ, ১ কোটি ৮৫ লাখ দিয়ে ভবন সম্প্রসারণ, ৩ কোটি ৪১ লাখ দিয়ে প্লান্ট ও মেশিনারী ক্রয়, ৩ কোটি ৩১ লাখ দিয়ে গ্যাস জেনারেটর ক্রয় ও বাকি ১ কোটি ৪ লাখ দিয়ে আইপিও ব্যয় করে।

ইউএসএ, বুলগেরিয়া ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০০৪ সালের ১৬ মার্চ কোম্পানিটি প্রাইভেট কোম্পানি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। আর বাণিজ্যিক অপারেশন শুরু করে ২০০৮ সালের ৩ মে। তবে কোম্পানির অনলাইনে ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ সুহৃদ প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বলে ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

কোম্পানিটি বিশেষ করে টেবলেট ও ক্যাপসুলের প্যাকেজিং এর জন্য পিভিসি ফিল্ম ও সুরিদ ও খাদ্য শিল্পের প্যাকেজিং এর জন্য পিপি ফিল্ম উৎপাদন করে।

(দ্য রিপোর্ট/আরএ/এপি/মে ১৪, ২০১৭)