দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : আফ্রিকান-আমেরিকান ধর্মীয় নেতা এলিজা মুহাম্মদ ১৯৭৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি নেশন অব ইসলাম নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বিখ্যাত ম্যালকম এক্স, লুই ফারা খান, মুহাম্মদ আলী ও তার ছেলে ওয়ারিথ দ্বীন মোহাম্মদের রাজনৈতিক গুরু।

এলিজা মুহাম্মদ ১৮৯৭ সালের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের স্যান্ডার্সভিলে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি উইলিয়াম পোল সিনিয়র ও মারিয়া হলের তেরো সন্তানের সপ্তম। তার নাম রাখা হয় এলিজা রবার্ট পোল।

চতুর্থ গ্রেডে পড়াকালে এলিজার পড়াশুনার সমাপ্তি ঘটে। পরিবারকে সাহায্য করতে মা-বাবার সঙ্গে বর্গাচাষের কাজ করেন। ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কারখানায় চাকরিসহ অন্যান্য ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময়ের মধ্যে পোকার আক্রমণ ও মন্দার কারণে কৃষি অর্থনীতির বিপর্যয়ের পাশাপাশি শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণার মুখোমুখি হন। এরপর অন্যান্য অনেক পরিবারের মতো তিনিও মিশিগানের হ্যামট্রামকে চলে আসেন। এরপর চলে যান ড্রেটয়টে। এর মধ্যে ১৯১৭ সালে ক্লারা ইভান্সকে বিয়ে করেন। তাদের আট সন্তান।

ড্রেটয়েটে থাকাকালে তিনি কালো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের সংস্পর্শে আসেন। এ সময় মারকুস গারবের প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সাল নিগ্রো ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩১ সালের আগস্টে স্ত্রীর অনুরোধে ওয়ালেস ডি ফার্ডের বক্তৃতা শুনতে যান। বক্তৃতার বিষয় ছিল ইসলাম ও কালোদের ক্ষমতায়ন। এরপর তিনি ফার্ডের সংস্পর্শে আসেন। তিনি তাকে আফ্রিকানদের স্বাধীনতা এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের ধারণা দেন। ফার্ডের কাছে এলিজার স্ত্রী ও ভাইয়েরাও দীক্ষা নেন। এরপর তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেন। নাম হয় এলিজা মুহাম্মদ। তিনি শিকাগোর আল্লাহ টেম্পল অব নেশন সংগঠনের টেম্পল টু এর দায়িত্ব পান। অন্যদিকে তার ছোট ভাই কালোট মুহাম্মদ নেতৃত্ব দেন ফ্রুট অব ইসলাম নামের আরেকটি আন্দোলনের। এ সময় হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন ফার্ড। পরে তিনি ড্রেটয়েট ত্যাগের শর্তে মুক্তি পান। এরপর আল্লাহ টেম্পল অব ইসলামের পরিবর্তন করে রাখা হয় নেশন অব ইসলাম।

১৯৩৪ সালে নেশন অব ইসলাম ‘ফাইনাল কল টু আল্লাহ’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রতিষ্ঠা করা হয় মুহাম্মদ ইউনিভার্সিটি অব ইসলাম। যা ড্রেটয়েটের পাবলিক স্কুল সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করে। এর কারণে এলিজাসহ ইউনিভার্সিটি অব ইসলামের কয়েক সদস্যকে জেলে যেতে হয়। পরে তারা মুক্তি পেয়ে আবারও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখেন।

দলের টেম্পল ওয়ানের নিয়ন্ত্রণ পেতে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। এ অবস্থায় তিনি ১৯৩৫ সালে ড্রেটয়েট ত্যাগ করে শিকাগো চলে আছেন। হত্যার হুমকির পর তিনি উইসকনসিনে এসে টেম্পল থ্রি এবং পরে ওয়াশিংটনে টেম্পল ফোর প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে ফার্ডের নির্দেশ করা ১০৪টি বই পড়েন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন না করায় ১৯৪২ সালে ৮ মে গ্রেফতার হন। জামিন পাওয়ার পর অ্যাটার্নির পরামর্শে ওয়াশিংটন ডিসি ত্যাগ করে ফিরে আসেন শিকাগোতে। অনুসারীদের নিবন্ধন না করার নির্দেশ দেওয়ায় সেখানে আবার গ্রেফতার হন। সাজা পেয়ে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মিলানের ফেডারেল কারেকশনাল ইনস্টিটিউশনে বন্দি থাকেন। মুক্তির পর নেশন অব ইসলামের দায়িত্ব নেন। ততদিনে সংগঠনের সদস্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪শ’তে। ১৯৪৬ সালে টেম্পল সংখ্যা ছিল চার, ১৯৫৯ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়ায় পঞ্চাশে।

ফার্ড ও তার তত্ত্ব মতে, কালোরা হলেন ‘আসল’ মানুষ, অন্যদিকে সাদারা হলো ‘মন্দ’- যারা হাজারো বছর ধরে কালোদের নির্যাতন করছে। নেশন অব ইসলামের লক্ষ্য হলো হীনমন্য সাদাদের হাত থেকে নিজেদের উত্তরাধিকার ফেরত নেওয়া। তরুণদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত ছিল। তার কারণে আফ্রিকান-আমেরিকান খ্রিস্টানদের অনেক গির্জায় যাওয়া বাদ দেয়। কারণ গির্জা তাদের প্রয়োজনগুলোকে বুঝতে পারে না। তিনি কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেন। প্রচুর ভূ-সম্পত্তি কিনেন এবং আবাসন শিল্পে বিনিয়োগ করে কালো তরুণদের কাজের ব্যবস্থা করেন।

১৯৭০ এর দশকে নেশন অব ইসলাম মিশিগান, আলাবামা ও জর্জিয়ায় বেকারি, নাপিতখানা, কপিশপ, মুদিখানা, লন্ড্রি, মুদ্রনখানা, আবাসন শিল্প, পোশাক শিল্প ও খামারসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ পরিচালনা করেন। ১৯৭২ সালে তারা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে আনেন। ১৯৭৪ সালের মধ্যে দেশের ৪৭টি শহরে স্কুল খুলেন। তাদের জমি ছিল ১৫ হাজার একর। নিজস্ব বিমান পরিবহনও ছিল। ১৯৭২ সালে তিনি অনুসারীদের বলেন, সংগঠনের সম্পত্তির মোট মূল্য ৭৫ মিলিয়ন ডলার।

তার ধারা বজায় রেখে মূলধারার একটি সংগঠনের জম্ম নেয় ১৯৭৬ সালে। নাম ‘আমেরিকান সোসাইটি অব মুসলিমস’। অবশ্য লুই ফারা খানের অবসরের পর এলিজার ছেলে ওয়ারিথ দ্বীন মুহাম্মদ আবার আগের নামে ফিরে আসেন। এখন পর্যন্ত সংগঠনটি টিকে আছে।

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ড্রেটয়েট শহরের লিনউড অভিনিউ পরিবর্তিত হয় এলিজা মুহাম্মদ বুলভার্দ নামে। ২০০২ সালে পণ্ডিত মোলেফি কেটে আসানটে তাকে শ্রেষ্ঠতম ১০০ আফ্রিকান আমেরিকানের তালিকায় রাখেন। স্পাইল লি পরিচালিত ‘ম্যালকম এক্স’ (১৯৯২) ছবিতে এলিজা চরিত্রটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া মাইকেল মানের ‘আলী’ (২০০১) ছবিতেও তার চরিত্র হয়েছে। ১৯৯৬ সালে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র ‘হোয়েন উই উয়ার কিংস’ তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ব্রংকাইটিস ও এজমায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এমডি/এএল/ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪)