ছাত্রদল কমিটি শিগগিরই ভেঙে দেওয়া হবে
ঢাবি কমিটি এখন থেকে আর নাই : খালেদা জিয়া
তারেক সালমান, দ্য রিপোর্ট : আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি, মহানগর কমিটি শিগগিরই ভেঙে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছেন সংগঠনের প্রধান অভিভাবক বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব এই মুহূর্তে কারাগারে থাকায় মানবিক কারণে কমিটি ভাঙা হচ্ছে না। তবে কারামুক্ত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে ছাত্রদলকে পুনর্গঠন করা হবে। একই সঙ্গে শিগগিরই ঢাকা মহানগর বিএনপি, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিও পর্যায়ক্রমে ভেঙে নতুন কমিটি দেওয়া হবে। তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি এখন থেকে আর নাই।’
সোমবার রাত ৯টা থেকে ১১টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ ঘোষণা দেন।
খালেদা জিয়া এ সময় ছাত্রনেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন কমিটি না দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা দায়িত্ব পালন করে যাবে। নতুন কমিটি দেওয়ার পর নতুন নেতৃত্বকে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে এবং তাদের সার্বিক সহযোগিতা করবে।’
বিএনপি প্রধান ঘোষণা করেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপি ও এর সকল অঙ্গসংগঠনের কমিটির যে সময়সীমা নির্ধারিত আছে, এখন থেকে তার একদিন বেশিও কমিটি দীর্ঘায়িত হবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি মহিদুল হাসান হিরু দ্য রিপোর্টকে বলেন, দীর্ঘসময় ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। তিনি আমাদের কাছে আন্দোলনে আমরা কেন ব্যর্থ হয়েছি, তার কারণ জানতে চেয়েছেন। আমরা তাকে ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে অবহিত করেছি।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্রদল নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ছাত্রদলের প্রতি ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও চরম বিরক্ত। যতক্ষণ আমরা উনার সামনে ছিলাম, সবাই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তিনি জানান, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুল ইসলাম ফিরোজ এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসিরকে দেখে তিনি ধমকে উঠেন। তিনি বলেন, ‘এই তোমরা এখানে কেন? আমিতো ডেকেছি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলকে। তোমরা কেন এসেছ?’
ওই ছাত্রদল নেতা আরও বলেন, নাসির বক্তব্য দিতে কয়েকবার উঠে দাঁড়ালেও ম্যাডাম ধমক দিয়ে বলেন, ‘এই বস। তোমার বক্তব্য দিতে হবে না। তোমরা ব্যর্থ। তোমাদের কোনো বক্তব্য শোনা হবে না।’
ওই ছাত্রনেতা বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও শহীদুল্লাহ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহাব ম্যাডামের অনুমতি নিয়ে তার বক্তব্যে বলেন, ‘ম্যাডাম, ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি আগে ছাত্রলীগ করত। সে ছাত্রদলের মিছিলে গুলিও করেছিল। আর বিগত সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু-আমিরুল ইসলাম আলিমের ছাত্রদল কমিটি হওয়ার পর তারা যখন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন, সেদিন ছাত্রলীগের সহযোগিতায় মাসুদ পারভেজ ছাত্রদলের ওপর গুলি করেছিল। টুকুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। তার পুরস্কার হিসেবে সে ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছে। এসব কি আপনি জানেন না ম্যাডাম? আপনাকে জানতে হবে। কেন ছাত্রদল আন্দোলনে সফল হতে পারে না।’
জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি কেমনে জানব। কমিটিতো করেছে ওরা। আর এ্যানীইতো সব জানে। সেতো আমাকে কিছু জানায়নি। কি তুমি জানতে না?’ এ সময় এ্যানী চৌধুরী চুপ করে থাকেন বলে ওই ছাত্রনেতা জানান।
আরেক ছাত্রদল নেতা জানান, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির একজন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের নাম সরাসরি উল্লেখ করে এবং আরেকজনকে ইঙ্গিত করে বক্তব্যে কয়েকজন ম্যাডামকে কমিটি নিয়ে পদ বাণিজ্যের কথাও অবহিত করেন। এ ছাড়া সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে বড় পদে বসিয়ে নেতাদের মধ্যে প্রটোকল সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও কেউ কেউ তাদের বক্তব্যে তুলে ধরেন। এই সমস্যার কারণে অনেক সিনিয়র নেতা (যাদের জুনিয়রের নিচে পদ দেওয়া হয়েছে) সংগঠনের কাজে কোনো উৎসাহ পান না বলেও ছাত্রনেতাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে।
ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এজমল হোসেন পাইলট দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমি ম্যাডামকে বলেছি ছাত্রদলকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা উচিত। এজন্য একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকা দরকার। এটা হতে পারে ২৫ থেকে ২৭ এর মধ্যে, যাতে করে ছাত্রত্ব শেষ করে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা ইচ্ছা করলে চাকরিতে চলে যেতে পারেন। ঢাবি ছাত্রদল কমিটি প্রকৃত ও আবাসিক ছাত্রদের দিয়ে করা উচিত। সেক্ষেত্রে যারা মাস্টার্সের ছাত্র তারা হল কমিটির সভাপতি ও যারা অনার্সের ছাত্র তারা সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য পদ পেতে পারেন। এভাবে হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগ কোনো অজুহাতেই ছাত্রদলকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে পারবে না।’
পাইলট বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বসয়সীমা শিথিল হতে পারে। কারণ তারা ফুলটাইম রাজনীতির মধ্যেই থাকেন। তাছাড়া ছাত্রদল কমিটি হওয়ার আগে অনেকে সিংহ থাকে আবার কমিটি হওয়ার পর তারাই গাধা হয়ে যায়- এ বিষয়টির দিকেও নজর দেওয়া উচিত।’
এদিকে, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় ও ঢাবি কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় শেষে বাইরে অপেক্ষমাণ বিপুলসংখ্যক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্রদলকর্মীদের তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান খালেদা জিয়া। যারা ঢাবির নিয়মিত ও আবাসিক কার্ডধারী ছাত্র, তাদের পরিচয়পত্র দেখে দেখে বৈঠককক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ছাত্রদের কার্ড দেখে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দেন।
পরে এ সব নিয়মিত ছাত্রদের সঙ্গেও খালেদা জিয়া অনেকক্ষণ কথা বলেন। তাদের বক্তব্যও শোনেন।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্নাঙ্গ কমিটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমাণ ছাত্রদল নেতাকর্মীরা। যারা ইতোমধ্যেই নিজেদের ছাত্রত্ব হারিয়ে ফেলেছেন, তারা দলীয় প্রধানের সঙ্গে মতবিনিময় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অনেকে দুঃখ করে বলেন, ‘ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পেতে জেল-জুলুম সহ্য করেছে।। কিন্তু কমিটিতে স্থান পেলাম না। চাকরির বয়সও হারিয়ে ফেলেছি। অথচ আমাদের কোনো মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।’
সভায় বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসির, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মহিদুল ইসলাম হিরু, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ খান পারভেজসহ কমিটির সুপার ফাইভ নেতা, জহুরুল হক হলের সভাপতি হুমায়ুন কবির, মহসিন হলের সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট, এসএম হলের সভাপতি বায়েজিদ আরেফিন, মুজিব হলের সভাপতি মামুন বিল্লাহ, রোকেয়া হলের সভাপতি সাহানুর নার্গিস, মহসিন হলের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক, সূর্যসেন হলের সাধারণ সম্পাদক করিম সরকার, শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওহাব, ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক হাসানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা দলীয় প্রধানের সঙ্গে মতবিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রদল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর আগে হল কমিটি করার পর নতুন কমিটি না হওয়ায় অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। তাই অনেক হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা অনুপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, নির্বাচনের আগে নাশতকার মামলায় ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
(দ্য রিপোর্ট/টিএস/এমডি/এজেড/ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪)