মাহফুজ পারভেজ-এর গল্প মোহনা
আমি যেখানে এসেছি, সেখানে আগে কেউ কোনদিন কাপড় গায়ে দেয়নি। বস্ত্র এখানে এলিয়েনের মতো নবাগত এবং রহস্যখচিত। সবুজ পাতায় নগ্নতা ঢেকে নারী-পুরুষ ঘন জঙ্গলের এ গ্রামটিতে হাঁটাহাঁটি করলে মনে হয় জীবন্ত উদ্ভিদ ছোটাছুটি করছে।
আমি যেখানে এসেছি, সেখানে আগে কেউ কোনদিন কাপড় গায়ে দেয়নি। বস্ত্র এখানে এলিয়েনের মতো নবাগত এবং রহস্যখচিত। সবুজ পাতায় নগ্নতা ঢেকে নারী-পুরুষ ঘন জঙ্গলের এ গ্রামটিতে হাঁটাহাঁটি করলে মনে হয় জীবন্ত উদ্ভিদ ছোটাছুটি করছে।
‘রাফাআত্তা, তোমাকে এটি পড়তে হবে।’আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। ওর চোখের আগুন আমার হাতে-ধরা কাপড়টিকে মনে হয় ভস্ম করে দিল। গত সাত দিনে কম করে হলেও একুশবার প্রত্যাখ্যান করেছে আমার নির্দেশ। নির্দেশই বলা যায়। রিফিউজি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জন্য জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তার সাধারণ কথাই তো নির্দেশ। আমরা তাদের নিরাপত্তা, খাদ্য ও আশ্রয় দিতে হাজার মাইল দূর থেকে অবতারের মতো ছুটে এসেছি। আমাদের বন্ধুরা ওদেরকে যুদ্ধ ও দাঙ্গার মধ্যে ফেলে দিয়েছে আর আমরা দিচ্ছি নিরাপত্তা! আমাদের বহুজাতিক বাহিনী সঙ্গিন উঁচিয়ে চারদিক থেকে বিপন্ন মানুষগুলোকে নিরাপত্তার সংজ্ঞা শেখাচ্ছে। প্রতিদিনই খুব ভোরের দিকে সৈন্যদের ছাউনি থেকে টলতে টলতে কিছু মেয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসছে। তাদের প্রত্যাবর্তনকে নিশ্চিতভাবে নিরাপত্তার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হিসেবে গণ্য করছে কর্তৃপক্ষ। কয়েক দিন সেসব ‘নিরাপত্তা বিষয়ক ট্রেনিং’প্রাপ্ত প্রশিক্ষিত মেয়ে আর ঘর থেকে বেরুতে পারছে না। তাদের কুঠরিতে গ্রাম্য ওঝা ও ধাত্রীদের আনাগোনার পর মেয়েগুলো যখন দীর্ঘ বিরতি ভেঙে বাইরে আসে, সঙ্গে থাকে তাদের চোখের অবাক চাহনি। পৃথিবীর সবকিছুকে তারা সন্দেহ, ভয়, বিস্ময়, ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। মানুষ এমন চোখেও তাকায়, এমন অচেনা চোখও মানুষের হয়, এই উপদ্রুত অঞ্চলে না এলে আমার অজ্ঞাত থাকতো।
আমি এখানে আসার আগেই রাফাআত্তার পালা হয়ে গেছে। নিরাপত্তা বলতে সে এখন বোঝে বাইরের অচেনা মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকা। আমি যতটুকু ওদের ভাষা বুঝি, তাতে মনে হয় আমার কাছ থেকে সে কিছুই নেবে না। শুধু একটি বাক্যই বারবার বলছে সে। পাদ্রি জোসেফ কথাটির অনুবাদ করেছেন এ রকম: ‘আমি কিছুতেই আমার পবিত্র স্তন ও গোপনাঙ্গে তোমাদের কোন কিছুকেই আর স্পর্শ করতে দেবো না।’ডাক্তার হিসেবে অন্য কোনও পথই খোলা নেই আমার সামনে। রাফাআত্তার মেয়েলি অঙ্গে যে সংক্রামক হানা দিয়েছে, তার জন্য প্যাডে পুরু করে মলম দিয়ে তা সেখানে লাগিয়ে রাখতে হবে। আমি বুঝি, ওরা বাঁচতে এসেছিল, জীবাণু নিতে আসেনি। রাফাআত্তার মতো সমস্যা আরও কয়েকজন মেয়ের মধ্যেও দৃষ্টিগোচর হওয়ায় বাধ্য হয়ে একজন মহিলা ডাক্তার আনতে হয়েছে।
ক্যামেরুনের মেইনল্যান্ড থেকে বহুদূরের এই নিভৃত বনাঞ্চলে শেষ পর্যন্ত আমাকেই পাঠানো হলো। কিন্তু কাউকেই আমি বিশ্বাস করাতে পারছি না যে, আমি একজন চিকিৎসক, আমি তাদের ভালো চাই। আমি আসলেই অন্যদের মতো নই। আমার কাছ থেকে যা পাবে, তার নাম সেবা, আঘাত নয়। আমার খুব কষ্ট হয়। আমি নিজেকে, নিজের কাজকে তুলে ধরতে পারছি না। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি ‘মানবতা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমার জীবন, আমার পেশা, আমার আকুলতা, সবকিছু মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার এই আদিবাসী অঞ্চলে আদিমতা বলতে আসলে খুব বেশি কিছু নেই। বাইরের লোকজন চলে এলে প্রাকৃতিক আদিমতা নিখাদ থাকতে পারে না। যা এখনও রয়েছে বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল, তা হলো স্থানীয় মানুষ, তাদের মন ও শরীর। কিন্তু এসবও আর শুদ্ধ থাকতে পারছে না। আমি জানি, আমিই এখানে প্রথম বাইরের মানুষ নই। আগেও অনেক মানুষ এখানে এসেছে, বনে আস্তানা গেড়েছে, চলে গেছে, পরে আবার এসেছে। পাহাড়-জঙ্গলের রাজ্যে তারা সম্পদ ও সুখ খুঁজে নিয়েছে। লুকিয়ে থেকেছে মোক্ষ লাভের লোভে। গভীর জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে গড়ানো অজস্র সরু সরু শ্বাপদের প্রায়ন্ধকার চিহ্নের মতো বাইরের মানুষও এঁকে দিয়েছে নিজেদের এমনই পরিচিতি ও উপস্থিতি যে, বনের পশু ও বাইরের মানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না আদিবাসী রাফাআত্তারা। যতই দিন যাচ্ছে, আমিও ততই অচেনা হয়েই থাকছি তাদের কাছে। একজন নারী, সংবেদনশীল মানুষ, সাহায্যের হাত-বাড়ানো চিকিৎসক নই, আমিও তাদের কাছে কেবলই বাইরের একজন অচেনা মানুষ। যারা আসে, চলে যায়, নিয়ে যায় অনেক কিছু।
কেউ যে কিছু দিতে পারে, রাফাআত্তাদের স্মৃতিতে এমন একটিও অভিজ্ঞতা নেই। আমি কেমনে বোঝাবো, আমি অন্যদের মতো নই। আমি এসেছি সব ছেড়ে। আমার দেশের মাটি, বেদনার জীবন, চেনা মানুষগুলোর লোভ-লকলকে চোখ.... সব ছেড়ে আমি চলে এসেছি। আফ্রিকায় আমি যে শুধু চাকরি নিয়ে আসিনি, এসেছি বাকিটা জীবন বিশ্বস্ত কাউকে নিয়ে থেকে যাওয়ার জন্য। এমন বিশ্বস্ত, যা পাহাড়-দৃঢ়তা এবং অরণ্য-গভীরতার মতো সত্য। গভীর বেদনায় আমি এখানে চলে এসেছি... আসতে আসতে মনে মনে বিড়বিড় করেছি... ‘হৃদয়ে আমার গন্ধের মৃদুভার... তুমি নিয়ে চলো ছায়ামরিচের বনে... স্থির গাছ আর বিনীত আকাশ গাঢ়... সহিতে পারি না, হে সখি, অচল মনে...।’ কিন্তু এ আমি কোথায় এসেছি? আমার চেয়ে দুঃখিনী একেক জন রাফাআত্তা আমারই জন্য অপেক্ষা করছে এখানে। তারা জানে না, তাদের সঙ্গে আসলে আমার কতো মিল! আমার মনে হয়, যদি সম্ভব হতো, রাফাআত্তা বা ওর মতো কাউকে জড়িয়ে ধরে একটি আস্ত দুপুর কোন এক হ্রদের জলে গভীর কান্নায় ভেসে যেতে পারতাম, তাহলে মানুষ হিসাবে আমাদের নবজন্ম হতো। চৈত্রের দাহ ও শীতের প্রকোপ শেষে আমাদের হৃদয় আবার তৈরি করতে পারতো বসন্তের অনুভূতি। অতীতের ধুলোর আস্তরণ ও ভাঙা ইটের গাদার ভেতর লুপ্ত আমাদের গৌরবহীনতা থেকে চোখ মেলে দেখতে পেতাম বিস্তৃত নতুন জীবন ও আদি-অন্তহীন শুদ্ধতম বনানীর ভারি সুন্দর শোভা।
২.
রাফাআত্তার ঘা’টা কিছুতেই কমছে না। নার্স যা জানিয়েছে, দেখতে পেলাম অবস্থা তারচেয়েও মারাত্মক। ফরসেপ দিয়ে ঘায়ের সাদা অংশগুলো একটু একটু করে পরিষ্কার করে গজ চাপা দিয়ে ড্রেসিং করে দিচ্ছে নার্স। রাফাআত্তা চোখ বুজে উবু হয়ে বালিশে মাথা গুঁজে দিল। ওর মন ভালো থাকে না; ওর মন আজও ভালো নেই। শরীর প্রায়-অচল। চলৎশক্তি ব্যবহার করতে পারছে না। গোপনাঙ্গের ঘায়ের জায়গাটা থেকে ব্যথা ক্রম-বর্ধিষ্ণু ব্যাসার্ধের মতো পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভয় ও আতঙ্কে ওর চেহারা থমকে আছে। রাফাআত্তা ফরসেপের একটা খোঁচা খেয়ে চিৎকার করে উঠল... অ্যাঁ...! ক্ষেপে গেল সে-। ‘কী হচ্ছে এসব আমার সঙ্গে? চিকিৎসা না ছাই! দূর হও!’ নার্স মেয়েটা ভয় পেয়ে ফরসেপটা আরও ভুলভাবে নাড়া দিতেই প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল রাফাআত্তা।‘মা, মা, মা গো...’আমি দৌড়ে কাছে চলে এলাম। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দু’পায়ের সন্ধিস্থল। রক্ত দেখে রাফাআত্তা আরও ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করলো। ব্যথায় ওর শরীর ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে গেছে। নার্স মেয়েটি রাফাআত্তার চিৎকারে এতটাই ভয় পেয়ে গেছে, কাঁপছে ঠকঠক করে। ‘কী হয়েছে?’আমি জানতে চাইলাম। ‘আমাকে মেরে ফেলবে। আর সহ্য করতে পারছি না।’ চোখ বন্ধ করে অস্ফুটে বললো রাফাআত্তা। নার্স তার যন্ত্রপাতি নিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালাম। ‘তুমি তোমার কাজ করো।’ ‘নাহ! ডক্টর...’ ‘আঃ... কাজ করো।’ নিজেই রাফাআত্তার ক্ষত গজ দিয়ে ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে বললাম, ‘নাও শুরু করো’। রাফাআত্তা আবার মুখ গুঁজল বালিশে। নার্স ড্রেসিং শুরু করলো। আমি আর দাঁড়ালাম না। পাশের ঘরে চেম্বারে চলে এলাম। কত আর আর্তনাদ শুনতে ভালো লাগে। প্রতিদিন অনেক মেয়ে গোপন বীভৎস ক্ষতের রক্ত, পুঁজ, যন্ত্রণা নিয়ে পাশবিক চিৎকার করেছে। তাদের অসুখ নিজেদের দোষের জন্য হয়নি। অসুখ তাদের দেহে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের কষ্টের ভাগ নিতে কেউ আসছে না। কেউ এতটুকু বিব্রতও হচ্ছে না। যেন এরচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা আর হয় না। এই চিৎকার, রোগভোগ, জীবাণু-বহন তাদের নিয়তিতে লেপ্টে দেয়া হয়েছে। আমি কি খুঁজবো দায়ীদের? কিভাবে খুঁজবো? অপরাধীরাই তো উদ্ধার কর্তা সেজে বসে আছে।
৩.
রাফাআত্তাদের কাছে আসার কিছুদিন ধরে আমার মনে সারাক্ষণ কেমন এক বিষণ্ণতা। কোন কিছুতেই আনন্দ নেই, ভালো লাগা নেই। এ ব্যাপারে আমি যে খুব সচেতন ছিলাম তা নয়। কিন্তু আজকাল বেশ অনুভব করছি। ভোরবেলা থেকেই টের পেতে থাকি, আমি আর আগের মতো স্বাভাবিক নেই। কিছুদিন হলো একটি অচেনা পাখি এসে বসত করছে জানালার পাশে মহুয়া গাছে। ভোরবেলা যখন ভালো করে আলো ফোটে না, তখন পাখিটা গান গায় আর আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথম যেদিন পাখিটি কিছুক্ষণ গান গেয়ে উড়ে চলে গেল, ক্রমশ দূরে মিলিয়ে গেল পাখিটির কণ্ঠস্বর। টের পেলাম আমার মন কেমন করে উঠছে। আমি অনুভব করতে পারি আমার বিষণ্ণতা। তারপর থেকে রোজ পাখিটা ঘুম ভাঙিয়ে নাড়া দিয়ে যায় আমার বিষণ্ণতায়। আমি তখন নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকি দূরের উপবনের দিকে। এই ব্রাহ্মমুহূর্তে, এখনও সূর্য ওঠেনি, এই সময় বেরিয়ে পড়া আমার কাছে একদা সুখকর ছিল। এ সময় প্রকৃতি থাকে একেবারে ছোটবেলায়। আজকাল আমি আর সেই ছোটবেলার বিশুদ্ধ জগতে ফিরে যেতে পারছি না। কোথাও আটকে আছি; বিষণ্ণতায়, যন্ত্রণায়, ঘৃণায়। হাঁটতে হাঁটতে আফ্রিকার এই বিজন অরণ্যে এখন আমার সঙ্গী হয় চার পাঁচ রকমের কুকুর। বাড়ি থেকে বেরুতেই যে কুকুরগুলো একজোট হয়ে আমার পিছু নেয়, তাদের সবার গায়ের রং লাল...। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে হ্রদের তীরে যে কুকুরগুলোর দেখা পাই, সেগুলো সব কালো। তারপর কালো-সাদা। আমি মনে মনে হাসি, কুকুরগুলোর প্রত্যেকটিরই একটি আইডেনটিটি আছে। একটা ক্লাস আছে। শুধু রাফাআত্তাদের কোন ক্লাস নেই। পৃথিবীব্যাপীই তারা শ্রেণীবিহীন, এক ও অভিন্ন যৌবনবাহী বিলাস। হাঁটতে হাঁটতে আর নিজের মনে ভাবতে ভাবতে এক সময় আমার মনে হয়, পুরো পৃথিবীটাকে কারা যেন একটি ভোগের পেয়ালা বানিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর মানুষগুলো সেখানে হাবুডুবুরত মাছি। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়, খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়। মনে হয় নামগোত্রহীন বন্য কীট-প্রতঙ্গের চেয়েও ক্ষুদ্র। আমার বিমবিষা বোধ হয়... ‘ওয়াক থু’...খানিকটা বমি হয়ে যায়। কী আশ্চর্য! আমি আমার আত্মা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার বমনের সঙ্গে আত্মাটিও বের হয়ে গেছে? আমি তাকিয়ে দেখি, দূরে গভীর জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একখ- সবুজ-অন্ধকার ঘুমিয়ে রয়েছে। যেন পাতালে নেমে গেছে এই দুর্ভেদ্য বনস্থলী। আমার চারপাশে নেড়া পাথুরে বিস্তৃতি, জায়গায় জায়গায় ঘাসজমি, চারদিকে বিবর্ণ আকাশ। আমাকে মনে হচ্ছে ঘিরে ধরেছে একদল শুয়োর, একদঙ্গল মোষ, দলবদ্ধ হায়েনা...। একের পর এক পশুদল আমাকে তছনছ করছে। রক্তাক্ত ও ব্যবহৃত করছে। তারপর আমার রক্ত-মথিত উলঙ্গ দেহ ফেলে জিহ্বা চাটতে চাটতে চলে যাচ্ছে। আমাকে তখন চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরেছে শুধু পিঁপড়া, পিঁপড়া, ক্ষুধার্ত পিঁপড়া। সারি সারি পিঁপড়া উচ্ছিষ্টের উপভোগ করছে আমার শেষ অবশেষটুকু। আমার গা ছমছম করে উঠলো। আমি কি রাফাআত্তা হয়ে যাচ্ছি? নাকি আমিও আসলে রাফাআত্তার নিয়তিরই একটি অংশ! আমার কেমন যেন রূপান্তর হচ্ছে। কেমন যেন শীত শীত করছে। চারদিকে কেবল ধূসর, আবছা কুয়াশা দেখছি। এখন তো শীতকাল নয়? অথচ উইন্টারের ঠাণ্ডা আমাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে। আমার ভেতর ও বাইরে মৃত্যু-শীতল-স্রোত বয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, অবিকল রাফাআত্তার মতো আমিও চেঁচিয়ে বলছি... ‘মা, মা, মা গো...’।আমার গলা ফেটে যাচ্ছে। অথচ কেউ মনে হয় আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে না। বাইরে নৈঃশব্দ, মনের ভেতরে ভারি উচাটন! আমার গভীরে গুমড়ে মরছে কঙ্গোর জঙ্গলে পথহারা লিভিংস্টোন। তিনি গিয়েছিলেন এক নদীর উৎস সন্ধানে। আর আমি চলেছি এমন একটি চোরা মোহনার খোঁজে, যেখানে রয়েছে শান্তি। আমি জানি না, পৃথিবীর বিকৃত-আধুনিক আয়োজন থেকে আর কত কত দূরে চলে গেলে তারপর আমি পাবো সেই শাশ্বত মোহনা?
৪.
উপবনের প্রান্তে, মাঠের শেষটায় এই নিম গাছটার চারপাশে স্বপ্নচারীর মতো কতক্ষণ হেঁটেছি মনে নেই। এক সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো দুটো কুকুরের স্তব্ধ ভঙ্গির দিকে নজর যেতেই কল্পনার সুতা ছিঁড়ে কেউ যেন আমাকে আছড়ে ফেলল প্রত্যক্ষের কঠিন মাটিতে। আমার চারপাশের কে কোথায়? সব শূন্য হা-হা করছে। দৃষ্টিসীমায় দুটো কুকুর ছাড়া প্রায়ন্ধকার গিলে খাচ্ছে দূরের আবছা রাফাআত্তাদের গ্রামের অবয়বটুকু। কুকুর দুটো সেই গ্রামের দিকে তাকিয়ে জিহ্ব বের করে পাথরের মূর্তি হয়ে আছে। নিশ্চয় ওদের ভীষণ খিদে পেয়েছে; নাকি, ওরাও ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে রাফাআত্তারা আর তাদের গ্রামকে ঘিরে পুঞ্জিভূত মর্মান্তিক কোন অনাগত বাস্তবের?এই ভোরে এখনও ঘুমে নিস্তব্ধ বনানীর প্রান্ত ছুঁয়ে গ্রামের পাড়ার মধ্য দিয়ে টলতে-টলতে নিজের ক্যাম্প-ঘরে ফেরার সময় আমার মনে হয়, চতুর্দিকের এ পাথুরে নিথরতার গর্ভেই উপ্ত ধ্বংসের বীজ এবং সেখানেই একটি বিশুদ্ধ নদীর উৎস ও মোহনার আঁতুড়ঘর কাছে কোথাও মুখ লুকিয়ে রেখেছে। একটি নদীভ্রূণের জন্ম-প্রতীক্ষায় আমার চিরায়ত নারী-সত্তা, আমার চিকিৎসক-অস্তিত্ব সাব-সাহারার কান্টি-মিউজিকের হাহাকার সুরের সঙ্গে একাকার বাজতে থাকে।
[ড. মাহফুজ পারভেজ: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]