বুক বিল্ডিংয়ের দীর্ঘসূত্রতায় পুঁজিবাজারে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে কোম্পানিগুলো
বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনে পার হচ্ছে দীর্ঘ সময়। এতে কোম্পানিগুলো ভোগান্তিতে পড়ে শেয়ারবাজারে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
একটি কোম্পানিকে ‘রোড শো’ ও বিডিংয়ের ২টি অতিরিক্ত ধাপ পার করতে হয়। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রথমে কোম্পানিগুলোর ‘রোড শো’ আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যাতে টাকা সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা অবহিত হতে পারে। এর পরবর্তীতে নিলামের জন্য বিডিংয়ের অনুমোদন পেতে হয়।
প্রিমিয়ামসহ শেয়ারবাজারে আসতে চাইলে পাবলিক ইস্যু রুলস-২০১৫’তে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই পাবলিক ইস্যু রুলস জারি করা হয়েছে। এরই আলোকে বেশ কিছু কোম্পানি ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে। তবে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি কোম্পানি বিডিংয়ের অনুমোদন পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ১০ মাস।
‘রোড শো’ সম্পন্ন করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে – ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল অ্যাপোলো হাসপাতাল ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়া একই বছরের ১২ এপ্রিল আমরা নেটওয়ার্ক, ৩০ জুন বসুন্ধরা পেপার মিলস, ৯ অক্টোবর বেঙ্গলপলি অ্যান্ড পেপার স্যাক লিমিটেড, ১৯ অক্টোবর রানার অটোমোবাইলস, ২৪ অক্টোবর পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস, ৬ অক্টোবর ডেল্টা হসপিটাল, ১৮ অক্টোবর ইনডেক্স অ্যাগ্রো ইন্ডাষ্ট্রিজ এবং চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল এ্যাস্কয়ার নিট কোম্পোজিট ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে।
‘রোড শো’ সম্পন্ন করা এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে একমাত্র আমরা নেটওয়ার্ক বিডিং এবং আইপিও অনুমোদন পেয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে একটিও বিডিং বা আইপিও কোনটিরই অনুমোদন পায়নি।
আমরা নেটওয়ার্ক কর্তৃপক্ষ ১২ এপ্রিল ‘রোড শো’ সম্পন্ন করে। এতে ঋণ পরিশোধ, আধুনিকায়ন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে পুঁজিবাজার থেকে ৫৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করার কথা জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিডিংয়ের অনুমোদন পায় ২১ ডিসেম্বর এবং চলে চলতি বছরের ৫-৮ ফেব্রুয়ারি। আর আইপিও অনুমোদন পেয়েছে ১৩ জুন। এখনো টাকা পেতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে আইপিওতে আবেদনের সময় নির্ধারণ, লটারি এবং শেয়ার লেনদেন শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির রোড শো থেকে টাকা উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর সময় লাগবে।
ব্যবসায় সম্প্রসারণের লক্ষে অ্যাপোলো হাসপাতাল শেয়ারবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে চায়। এ ক্ষেত্রে ৪ এপ্রিল ‘রোড শো’ আয়োজন করে। এ ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের ব্যবসায়িক চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘রোড শো’র পরে ১৫ মাস পার হতে চললেও বিডিংয়ের অনুমোদন পায়নি।
বসুন্ধরা পেপার মিলস ২০০ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষে ‘রোড শো’ করেছে। কারখানার আধুনিকায়ন ও মেশিনারি আমদানি করার লক্ষে এ টাকা সংগ্রহ করতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির ‘রোড শো’তে ২০১৬ সালের (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ের ব্যবসায়িক অবস্থা তুলে ধরা হয়।
চিকিৎসা সেবা বাড়ানোর লক্ষে ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও ঋণ পরিশোধ করার লক্ষে শেয়ারবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে চায় ডেল্টা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। এ লক্ষে ৬ অক্টোবর ‘রোড শো’ আয়োজন করা হলেও এখনো বিডিংয়ের অনুমোদন পায়নি।
ব্যবসায় সম্প্রসারণের লক্ষে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করার লক্ষে ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে ১৮ এপ্রিল এ্যাস্কয়ার নিট কোম্পোজিট।
এএফসি ক্যাপিটালের সিইও মাহবুব এইচ মজুমদার বলেছেন, ‘একটি কোম্পানির রোড শো করার পরেও এক বছরের বেশি সময় লেগে যায় বিডিংয়ের অনুমোদন পেতে। এরপরে আইপিও অনুমোদন পেতে আরও অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে বুক বিল্ডিংসহ ফিক্সড পদ্ধতিতে আইপিও অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে উদ্যোক্তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।’
আইডিএলসি ইনভেষ্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘রোড শো করার পরে বিডিং পেতে দীর্ঘ সময় লাগলে, স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাবটা কমে যায়। এ ক্ষেত্রে যত কম সময়ের মধ্যে বিডিং অনুমোদন বা বিডিং অনুমোদনের পরে রোড শো করলে ভালো হয়। এতে ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসতে উৎসাহিত হবে। এ ছাড়া বিডিং অনুমোদনের পরে দ্রুত ট্রেডিং চালু করলে ভালো হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিডিং অনুমোদনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ট্রেড শুরু হয়ে যায়। ফরেন ইনভেস্টররা সব সময় বিডিং ও ট্রেডিংয়ে সময়ের কম ব্যবধান চান।’
এদিকে ‘রোড শো’ করার পরে বিডিং অনুমোদনে দীর্ঘ সময়ের ক্ষেত্রে কোম্পানির উদ্দেশ্য অনেক সময় ব্যাহত হয় বলে জানান মনিরুজ্জামান। একটি কোম্পানির টাকার দরকার এখন, কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে যদি এক বছর পরে পায় তাহলে তা কাজে লাগানো কঠিন। এ ছাড়া আগে আইপিও পক্রিয়া শুরু করে কোম্পানিগুলো ঋণ নিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে। যা আইপিওর টাকা দিয়ে পরিশোধ করা হতো। কিন্তু এখন আইপিও’র টাকায় ঋণ পরিশোধে সীমাবদ্ধতা থাকায় তাও সম্ভব হচ্ছে না।
আমরা নেটওয়ার্কের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. এনামুল হক বলেছেন, ‘রোড শো এরপরে বিডিং অনুমোদন ও তা সম্পন্ন করতেই ১০ মাস সময় লেগে গেছে। এরপরে আইপিও অনুমোদন পেতে লেগেছে আরও ৫ মাস। এটা দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে একটি কোম্পানির অনেক পরিবর্তন হতে পারে। কোম্পানির মোটিভও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।’
এদিকে আইপিও অনুমোদন হলেও আবেদনের সময় নির্ধারনের জন্য সম্মতিপত্র, লটারি ও শেয়ার লেনদেন হতে অনেক সময় বাকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন এনামুল হক। এ হিসাবে শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু একটি প্রজেক্ট নিয়ে শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করতে চাচ্ছি। তবে দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়ার কারণে প্রজেক্টে বিলম্ব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইপিও প্রক্রিয়াটি দ্রুত হলে ভালো হয়।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেছেন, ‘রোড শোর কত পরে বিডিং ও আইপিও অনুমোদন হয়েছে সেটা বিষয় না। একটি কোম্পানি অনুমোদন পাওয়ার মতো সব শর্ত পূরণ করেছে কিনা সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যত দ্রুত শর্ত পরিপালন করবে, তত দ্রুত অনুমোদন পাবে।’
(দ্য রিপোর্ট/আরএ/জেডটি/জুলাই ১১, ২০১৭)