ত্রিপিটক পরিচিতি
দিরিপোর্ট২৪ ডেস্ক : বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ কোন গ্রন্থ রচনা করেননি। তিনি মৌখিকভাবে উপদেশ দিয়েছেন। সেই উপদেশগুলো সংকলিত হয়েছে ‘ত্রিপিটক’-এ। পালি ভাষায় রচিত গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। ‘পিটক’ শব্দের অর্থ বাক্স। ত্রিপিটক মানে তিনটি পিটকের সমাহার। এই তিনটি পিটক হচ্ছে- সুত্ত পিটক, অভিধর্ম পিটক ও বিনয় পিটক। সুত্ত পিটকে ধর্মবিষয়ক বার্তা, অভিধর্ম পিটকে দার্শনিক বিষয় এবং বিনয় পিটকে সংঘের আচার বিষয়ে গৌতম বুদ্ধের উপদেশ সংকলিত হয়েছে।
খ্রিস্ট পূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর সংকলনের কাজ শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পর অর্থাৎ খ্রিস্ট পূর্ব ৫৪৩ সালে। শেষ হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৩৬ সালে। প্রায় তিনশ বছরে তিনটি সংঘায়নের মধ্যে এর কাজ শেষ হয়।
বুদ্ধের সময়কালে সূত্রধর, বিনয়ধর এবং মাতিকাধর নামে তিন ধারার সাধনাকারী ভিক্ষু ছিলেন। এই তিন শ্রেণির সকলেই ছিলেন স্মৃতিধর। স্মৃতিধর ভিক্ষুগণ শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে বুদ্ধ বাণীকে সংরক্ষণ করতেন। তারা শিষ্য পরম্পরায় এই রীতি সক্রিয় রাখেন। ত্রিপিটক সংকলিত হওয়ার আগে সূত্রধরেরা সূত্র, বিনয়ধরেরা বিনয় এবং মাতিকাধরেরা অভিধর্ম পিটক স্মৃতিতে রাখতেন।
বিনয়পিটক: বিনয় পিটক বলতে এমন এক পিটককে বোঝানো হয়, যা হলো আচার আচরণের নির্দেশনা সংবলিত গ্রন্থ। মানুষ কিভাবে অপর মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে তার সুস্পষ্ট নীতিমালার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বিনয় পিটক। এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে এমন কিছু নীতিমালা যা আয়ত্ব করা একজন সৎগুণের মানুষের জন্য অপরিহার্য। বিনয়, নম্রতা ও ভদ্রতার অভাব দেখা দিলে একজন ধার্মিক ব্যক্তি আদর্শ বিস্তারের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। বিনয় পিটকে এ ধরনের সামাজিক গুণের বর্ণনা স্থান পেয়েছে। বিনয় পিটকের তিনটি ভাগ- সুত্তবিভঙ্গ, খন্দক ও পরিবার।
সুত্তবিভঙ্গ দুই ভাগে বিভক্ত- ভিক্ষুবিভঙ্গ ও ভিক্ষুনীবিভঙ্গ। এখানে বিশদভাবে ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদের অবশ্য পালনীয় নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। এমন কিছু অপরাধের উল্লেখ রয়েছে যার কারণে ভিক্ষু বা ভিক্ষুনী পতিত হয়। এরকম অপরাধের সংখ্যা ২২৭টি। সুত্তবিভঙ্গে এসকল অপরাধ ও পালনীয় নিয়ম বর্ণিত হয়েছে।
খন্দকে দুইটি গ্রন্থ রয়েছে- মহাবর্গ ও চুল্লবর্গ। এতে ভিক্ষু সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কিভাবে সংঘে প্রবেশ করা যায়, নানা সময়ে কোন কোন ব্রত পালন করতে হয়, চাতুর্মাস্য কিভাবে উদযাপন করতে হয়, ভিক্ষু কেমন কাপড় পড়বে, খাবারের জন্য কোন নিয়ম পালন করবে প্রভৃতি নিয়ম লিপিবদ্ধ রয়েছে এতে।
‘পরিবার’ হচ্ছে বিনয় পিটকের সারমর্ম। এতে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিয়ম ও কর্তব্য প্রতিপাদিত হয়েছে।
সুত্তপিটক: সুত্ত‘র বাংলা অর্থ হলো সূত্র। বৌদ্ধ ধর্মের মূল উপদেশ ও গৌতম বুদ্ধের ধর্মের প্রকৃত বাণী বর্ণিত হয়েছে এ সুত্ত পিটকে। বৌদ্ধ ধর্ম মতে, একজন মানুষ আপন সত্তাকে জানতে ও চিনতে চাইলে অবশ্যই এমন কিছু বাণী সমষ্টির উপলব্ধি আপন চিত্তে ধারণ করতে হবে, যার মাধ্যমে স্থির চিত্ত অর্জন করা সহজ হয়। সুত্ত পিটকের উপলব্ধিবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ কৌশল একজন মানুষকে অসীমের সান্নিধ্য লাভের যোগ্য করে তোলে। এই পিটকের অন্তর্গত পাঁচটি নিকায় রয়েছে- ১. দীঘ নিকায়, ২. মজ্ঝিম নিকায়, ৩. অঙ্গুত্তর নিকায়, ৪. সংযুক্ত নিকায়, ৫. খুদ্দ নিকায়।
দীঘ নিকায়ে তিনটি খণ্ড এবং এগুলোর মধ্যে ৩৪টি দীর্ঘ সূত্র রয়েছে। এরমধ্যে সর্বপ্রসিদ্ধ হচ্ছে মহাপরিনির্বাণ সুত্ত। দীঘ নিকায়ের প্রত্যেক সুত্তে বুদ্ধের সংবাদ সংকলিত আছে। এই সংবাদের বিষয় অনেক ধরনের, যেমন- যজ্ঞের উপযোগ আছে কিনা, কোন ব্যক্তির জন্ম উচ্চ বংশ বা নীচ বংশে কেন হয় এবং তা কি নিজের গুণকর্ম অনুসারে হয়, নির্বাণ, পুনর্জন্ম প্রভৃতি। মজ্ঝিম নিকায়ে মধ্য আকারের সর্বমোট ১২৫টি সুত্ত রয়েছে। এই সুত্তগুলি দীঘ নিকায়ের তুলনায় ছোট। অঙ্গুত্তর নিকায় ১১টি খণ্ডে বিভক্ত এবং সর্বমোট ২৩০০ সুত্ত রয়েছে। সংযু ক্ত নিকায় ৫টি বর্গে বিভক্ত এবং মোট ৫৬টি সুত্ত রয়েছে।খুদ্দ নিকায়ের অন্তভুক্ত আছে ১৫টি পুস্তক। এগুলো হচ্ছে- খুদ্দকপাঠ, ধর্মপদ, উদান, ইতিবুতক, সুত্ত নিপাত, বিমানবত্থু, থের গাথা, থেরী গাথা, জাতক, নিদ্দেস, পহিসম্মিদা, অপদান, বুদ্ধবংস, চরিয়াপিটক।
ধর্মপদ বৌদ্ধদের কাছে হিন্দুদের গীতার মতোই পবিত্র।জাতকে বুদ্ধের পুনর্জন্মের কথারূপে প্রায় ৫৫০টি গাঁথা বর্ণিত হয়েছে। তা বৌদ্ধধর্ম অনুসারে নির্বাণপ্রাপ্তির জন্য অত্যন্ত আবশ্যক মনে করা হয়।
অভিধর্মপিটক: একজন বৌদ্ধ সাধকের মেধা, মনন ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা আস্তে আস্তে বিকশিত হতে থাকে। ধ্যান সাধনার একনিষ্ঠতা তার কাছে আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় অনুভূত হতে থাকে। এ উচ্চতর ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক বাণীই মূলত অভিধর্ম পিটকের আলোচ্য বিষয়।
এই পিটকে বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক বিচার ও আধ্যাত্মবাদের আলোচনা রয়েছে। এর অন্তর্গত গ্রন্থসংখ্যা সাতটি- ১. ধর্মসঙ্গনি, ২. বিভঙ্গ, ৩. ধাতুকথা, ৪. পুলপঞ্জতি, ৫. কথাবত্থু, ৬. যমক, ৭. পট্ঠান।
ত্রিপিটক ছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পালি গ্রন্থ হলো খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে রচিত ‘মিলিন্দ পনহো’। বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেনের (১৫০ খ্রিস্ট পূর্ব) সঙ্গে গ্রিক রাজা ও দার্শনিক মিনান্দরের (মিলিন্দ)বিতর্কের আকর্ষণীয় বর্ণনা এতে অন্তর্ক্তুক্ত রয়েছে। আরো রয়েছে চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে মগধনিবাসী বুদ্ধ ঘোষ রচিত পালিভাষায় ত্রিপিটকের ভাষ্য ‘অট্ঠকথা’।
(দিরিপোর্ট২৪/ডব্লিউএস/এমডি/নভেম্বর ০৭, ২০১৩)