দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ভূমিধস নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কতগুলো সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও নিতে হবে।

শুক্রবার রাজধানীর তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনের চামেলী হাউজে ‘বাংলাদেশে ভূমিধস : কারণ, ফলাফল ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়াদি’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-চায়না কালচারাল এন্ড ইকোনমিক সেন্টার এবং ঢাকাস্থ চীন দূতাবাস যৌথভাবে এ সেমিনার আয়োজন করে।

রাশেদ খান মেনন বলেন, ভূমিধস নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কতকগুলো সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও নিতে হবে। এছাড়া ভূমিধ্বস নিয়ন্ত্রণে সামগ্রিক পরিকল্পনাও দরকার।

তিনি বলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করে নয় ভূমিধসের সত্যিকারের কারণ খতিয়ে দেখেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রধানত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট ভূমিধস হয়ে থাকে। এই দুই কারণকে মিলিয়েই ভুমিধস নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য আদীবাসীদের অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভুমিধসে জীবনহানীসহ ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে।

সেমিনারে মুল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম। নির্ধারিত আলোচকের বক্তব্য দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ এর পরিচালক ড. মাহবুবা নাসরিন, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান।

সভাপতিত্ব করেন বাপা’র সহ-সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ। উপস্থাপনা করেন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন। বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

মুল বক্তব্য উপস্থাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম বলেন, পাহাড় ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও অপরিকল্পিত ভাবে ব্যাপক হারে বন উজাড়, আবাসন ও রাস্তা তৈরীর জন্য পাহাড় কাটা, পাহাড়ী গাছ কাটা, পাহাড়ী অঞ্চলে প্রথাগত জুম চাষের পরিবর্তে সমতল ভুমির প্রযুক্তিতে চাষাবাদের বিস্তার ঘটানোসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে ক্রমাগত ভুমিধসের আশংকা বিরাজ করছে।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ভূমিধ্বস একটি অন্যতম দূর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশের দূর্যোগ ব্যবস্থাপানায় এটি এখনও দূর্যোগ হিসেবে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পায়নি। দূর্যোগ নীতিমালা ২০০৮, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০১০ এবং দূর্যোগ নির্দেশনায় (এসওডি) সাইক্লোন, বন্যা, এমনকি ভুমিকম্প ও সুনামী নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ভুমিধস নিয়ে তেমন আলোকপাত করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের ভুমিধসের পর বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। ওই রিপোর্টে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ২২টি সুপারিশ করা হয়েছিল। যার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ী এলাকা চিহ্নিত করা, সমন্বিত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, সমন্বিত ওয়াটার সেড ব্যবস্থাপনা অন্যতম। এছাড়াও একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরী করা দরকার। যাদের আইনীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থাকবে।

ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিধস গবেষণা কেন্দ্রের সূত্রের বরাতে অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ লাখ লোক ভূমিধসে নিহত হয়েছে। যার অধিকাংশই পর্বতময় স্বল্প উন্নত দেশভুক্ত। ১৯২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর চীনের নিংজিয়া ভূমিধসে ১ লাখ লোক নিহত হয়। যা ভূমিধসে নিহতের সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিগত চার দশকে বাংলাদেশে ভূমিধস একটি ভয়াবহ দূর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, মিশর, উগান্ডা, চীন, ব্রাজিল, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্থান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, গুয়েতমালা ও কলোম্বিয়ায় ১৪ বার ভূমিধসে ৩৫৩৭ জন থেকে ৫৩৩৭ জন লোক মারা গেছে। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা রাস্তায় ভূমিধসের প্রথম রেকর্ড করা হয়। এই ধসে প্রাণহানী না হলেও পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত ভূমিধ্বসে বাংলাদেশে প্রায় ৫৫০ জন লোক মারা যায় বলে জানান তিনি।

অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, বান্দরবান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম শহর, ক্যন্টনমেন্ট, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১২টি ভূমিধসে মোট ৪৪৮জন মানুষ মারা গেছেন। প্রচুর বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিপাত, হঠাৎ বন্যা, বন্যা, পাহাড়কাটা ও পয়নিষ্কাশন বিধ্বস্ত হয়ে এসব ভুমিধসের ঘটনা ঘটে।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, এখন থেকে প্রতি বছরে বাংলাদেশে ক্রমাগত বড় আকারের ভুমিধসের ঘটনা ঘটবে। এ বছরের চেয়ে আগামী বছর আরও বড় আকারের ভুমিধসের ব্যপকতা বাড়বে। তার পরের বছর আরও বড় ধরনের ভুমিধসের ঘটনা ঘটবে।

ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, কোনো গবেষণা প্রতিবেদন জনগণের বোধগম্য করে তৈরী করা হয় না। এসব প্রতিবেদনের অধিকাংশই ইংরেজি ভাষায় লিখে তৈরী করা হয়। এসব প্রতিবেদনের বেশীর ভাগেরই শেষ পর্যন্ত হদিস থাকে না। প্রতিবেদন তৈরীর পরপরই তা হারিয়ে যায়।

তিনি বলেন, পাহাড়ের গাছ কাটার ধরণ আলাদা। না বুঝে অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটলে ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। পাহাড়ের গভীর শিকড় বিশিষ্ট গাছ কাটা ঠিক নয়। আদীবাসীরা প্রধানত যেসব পাহাড়ে বসবাস করে সেখানে সাধারণত ভুমিধসের মতো ঘটনা ঘটেনি। কারণ তারা জানে কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সহঅবস্থান করে পাহাড়ে বসবাস করতে হয়।

(দ্য রিপোর্ট/এমএম/এমএইচএ/জুলাই ২১, ২০১৭)