রাবিতে টাকায় মিলছে গবেষণাপত্র
মো. মঈন উদ্দীন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) টাকার বিনিময়ের মিলছে গবেষণাপত্র। অন্যের গবেষণাপত্র, রিসার্স মনোগ্রাফ, ইন্টার্নশিপ রিপোর্ট কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের কম্পিউটারের দোকানগুলোতে মিলছে এসব রেডিমেড গবেষণাপত্র। হরহামেশাই থিসিস জালিয়াতি হলেও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেট ও স্টেডিয়াম মার্কেটে কম্পিউটারের দোকানগুলোতে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক গবেষণাপত্র, রিসার্স মনোগ্রাফ, ইন্টার্নশিপ রিপোর্টসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ প্রিন্ট ও বাঁধাই করেতে গেলে দোকানিরা তাদের কাছ থেকে কৌশলে কপি করে তা কম্পিউটারে রেখে দেন। পরে কোন শিক্ষার্থী এসব গবেষণাপত্র খোঁজ করলে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করেন সেই গবেষণাপত্র। শিক্ষার্থীরা কোন গবেষণা না করেই এসব রেডিমেড গবেষণাপত্রের কিছু অংশ পরিবর্তন করে শিক্ষকদের কাছে উপস্থাপন করেন।
সচেতন শিক্ষার্থীরা বলছেন, এভাবে গবেষণাপত্র জালিয়াতি অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক গবেষণার মানে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এ অবৈধ পন্থা অবলম্বনে ব্যাহত হচ্ছে গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। এছড়াও এসব গবেষণাপত্র থেকে মৌলিক কোন তথ্য উঠে আসছে না। জালিয়াতির এ সুযোগ গ্রহণের ফলে সংকীর্ণ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, আইন অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও বিজ্ঞান অনুষদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই থিসিস, রিসার্স মনোগ্রাফ, ইন্টার্নশিপের কাজ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের কাজ শেষে শিক্ষকের কাছে এসব গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়। অনেক শিক্ষার্থী রিপোর্ট ও গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেছে নেয় জালিয়াতির পথ। অন্যের তৈরি করা গবেষণাপত্র, রিসার্স মনোগ্রাফ, ইন্টার্নশিপ রিপোর্টের ভূমিকা-উপসংহার পরিবর্তন এবং ভেতরের কিছু তথ্য সংযোজন-বিয়োজন করে তা জমা দিয়ে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেট ও স্টেডিয়াম মার্কেটের দোকানগুলোতে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সাকসেস কম্পিউটারস, আল-আকসা ইন্টারন্যাশনাল, বর্ণমালা কম্পিউটার সেন্টার, আমার আইটি জব কর্ণার, কম্পিউটার পয়েন্ট, জান্নাত কম্পিউটারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি দোকানে এসব গবেষণাপত্র, ইন্টার্নশিপ রিপোর্ট ও রিসার্স মনোগ্রাফ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানি জানান, তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের গবেষণাপত্রের সফট কপি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের করা বিষয়ভিত্তিক গবেষণাপত্র ও ইন্টার্নশিপ রিপোর্টের বিষয় তালিকা করে রাখা আছে। শিক্ষার্থীরা এলেই ওই তালিকা দেখে তাদের ইচ্ছে মতো বিষয় বেছে নেন।
তবে এসব গবেষণাপত্র, রিসার্স মনোগ্রাফ, ইন্টার্নশিপ রিপোর্ট কত দামে বিক্রি হয় জানতে চাইলে ওই দোকানি বলেন, দুই শ’ টাকা থেকে শুরু এক হাজার টাকাও বিক্রি হয়। এগুলোর নির্ধারিত কোন দাম নেই। যার কাছ থেকে যেমন দাম রাখা যায়। প্রিন্ট করলে শুধু প্রিন্টের দাম রাখা হয়। আর প্রিন্ট না করে পেনড্রাইভে নিলে বেশি দাম দিয়ে নিতে হয়।
কারা এসব গবেষণাপত্র কিনতে আসে জানতে চাইলে ওই দোকানি বলেন, ‘সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও আইন অনুষদের শিক্ষার্থীরা বেশি আসেন।’
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গাফিলতির ফলে এমনটি হচ্ছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধিকর্তা অধ্যাপক ড. মো. ফয়জার রহমান বলেছেন, ‘আমাদের ছাত্র-শিক্ষক উভয়েরই নীতি-নৈতিকতার জায়গায় যথেষ্ট ঘাটতি আছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি শিখছেন সেটা চিন্তা করে না বরং এটা চিন্তা করে যে আমি কি গ্রেড পাবো। কেননা আমরা এখন গ্রেড দিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করছি, সে কি জানে সেটা দিয়ে নয়। তাই ভালো গ্রেডের আশায় তারা এমনটা করছে। আমাদের শিক্ষকরাও এসব গবেষণাপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখছে না। তাই শিক্ষার্থীরাও জালিয়াতির সুযোগ পাচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অধিকর্তা অধ্যাপক ড. মো. শিবলী সাদিক বলেছেন, ‘আমরা যখন ধরতে পারি বা বুঝতে পারি যে শিক্ষার্থীরা নকল করে এগুলো আমাদের কাছে জমা দিচ্ছে তখন আমরা শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দেই।’
এসবের ব্যবসা বন্ধে কি ব্যবস্থা নিবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘যারা এসব বিষয় নিয়ে ব্যবসা করছে আমরা তাদের ঠেকাতে পারি না। আমাদের ওই ক্ষমতা নেই। এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করতে আমরা এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবো।’
(দ্য রিপোর্ট/এপি/জেডটি/এনআই/জুলাই ২৩, ২০১৭)