চট্টগ্রামে নৌকাই এখন ‘ভরসা’
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : এ যেন পানির বুকে গজিয়ে উঠা কোনো শহর। পিচঢালা রাস্তার দেখা নেই। গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল নেই। রিকশা আছে, তবে তাতে চড়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া কম ঝামেলার নয়। ভরসা কেবল একটি মাত্র বাহনই। সেটি হলো নৌকা। চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চিত্র এখন এমনই।
শহরের কেন্দ্রে আগ্রাবাদের অধিবাসী রাশেদ রেজা। সাধারণত রিকশায় কর্মস্থলে আসা যাওয়া করেন। কিন্তু গত কয়েক দিনের দৃশ্য আলাদা। প্রবল বর্ষণ আর উত্তাল সাগরের প্রভাবে তীব্র জলাবদ্ধতায় কার্যত গত দু'দিনে অচল হয়ে পড়েছিলো তার এলাকা। এখন তাকে অফিসে আসা যাওয়া করতে হচ্ছে নৌকায়।
‘গত তিনদিন ধরে রিকশা একেবারেই অচল। অস্থায়ী ভিত্তিতে আমরা একটি নৌকায় করে যাতায়াত করছি। গতরাতেও বাসায় ফিরেছি নৌকায় করে।’-বলছিলেন রাশেদ।
তিনি জানিয়েছেন, শুধু যাতায়াত নয়, সংকট দেখা দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও। তার ভাষায়, ‘জরুরি জিনিসপত্র পাওয়া যায় না। ফার্মেসি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।’
রাশেদ রেজা একাই নন, কর্মস্থলে যাতায়তের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামে অনেকেরই এখন ভরসা কেবল নৌকা। এমনকি চট্টগ্রামের কর অঞ্চল-৪ এর কর্মকর্তাদের নৌকা কেনার খবরও সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যাতে অফিসে যাতায়াত করতে পারেন সেজন্যে সরকারি খরচে এই অফিসের জন্যে দুটো নৌকাও কেনা হয়েছে।
ওই অফিসেরই একজন দারোয়ান প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে কয়েকটি 'ট্রিপে' কর্মীদের অফিসে নিয়ে যান ও বাড়িতে পৌঁছে দেন। অফিস চলাকালে নৌকা দুটো রাখা একটি গাড়ির গ্যারেজে।
জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে শহরের ব্যবসায়িক কার্যক্রমও। আবার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল বাজার খাতুনগঞ্জে পণ্য রাখার গোডাউনেও ঢুকে পড়েছে পানি, তাতে করে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এহসানুল্লাহ জাহেদী।
তিনি বলেছেন, ‘খুবই বাজে অবস্থা। পানি রেকর্ড করেছে। বড় গোডাউনে পানি উঠেছে। অনেক ব্যবসায়ী কান্নাকাটি করছেন।’
কিন্তু এমন দুর্ভোগ আর কান্নার জন্য যে জলাবদ্ধতা দায়ী সেটি চট্টগ্রামে গত কয়েক বছরের পরিচিতি এক দৃশ্য।
তবে গত ছ'মাসে এ পর্যন্ত অন্তত তিনবার জলাবদ্ধতায় অচল হলো চট্টগ্রাম, পাশাপাশি পানি উঠেছে দেশের আরও বেশ কয়েকটি শহরে।
চট্টগ্রামের বেসরকারি সংগঠন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নেতা প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদারের মতে, অনেক দিক থেকেই কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে চট্টগ্রাম শহর।
তিনি বলেছেন, ‘আগ্রাবাদ, হালিশহর, বহদ্দারহাট এলাকার অনেকে বাড়িঘর ছেড়েছে। বিভিন্ন বিভাগ আলাদা করে প্রজেক্ট নিচ্ছে, যার কারণে ভবিষ্যতে সঙ্কট আরও বাড়বে।’
চট্টগ্রামের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছোট বড় শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি উঠেছে অতিবৃষ্টির কারণে। সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টার টানা বৃষ্টির পর পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ এলাকার সড়কগুলোও।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আখতার মাহমুদ বলেছেন, ‘মূল সমস্যা হলো খাল দখল করে পানি প্রবাহ বন্ধ করা। আর চট্টগ্রামের ড্রেনেজ মাস্টার প্লান হয়েছে ১৯৯৫ সালে কিন্তু তার কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আজই ৩০০ কোটি টাকার নদী খনন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের জন্য আর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ঢাকার জন্যও। এগুলোর কাজ শুরু হলে আগামী বছর থেকেই সঙ্কটের সমাধান হবে।’
তবে বিশেষজ্ঞ আখতার মাহমুদ বলেছেন, ‘খাল দখলের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রামের বাইরে দেশের অধিকাংশ শহর ও পৌরসভাগুলোতেও জলাবদ্ধতার সঙ্কট দিন দিন বাড়ছে যা সমাধানের কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো চোখে পড়ছে না।’
এমনকি ঢাকা চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরেও সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের যে অভাব রয়েছে সেটির কিভাবে সমাধান হবে সেটিও কারো জানা নেই।
প্রতিবেদন ও ছবি : বিবিসি বাংলার সৌজন্যে
(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/জুলাই ২৫, ২০১৭)