ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশ
‘বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল’
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সম্বলিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে প্রদান করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই সিদ্ধান্ত দেন সর্বোচ্চ আদালত।
এখন সরাসরি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে মন্তব্য করেননি রাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে রিটের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ করা যাবে।
মঙ্গলবার (০১ আগস্ট) ৭৯৯ পৃষ্ঠার আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে আদালত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সম্বলিত পূর্ববর্তী সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৪, ৫, ৬ ও ৭ উপ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের আরও দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সমণ্বয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন ও এই কাউন্সিলের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাই ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের ফলে কোনো বিচারপতির দায়িত্ব পালনে অসমার্থ্যতা বা অসদাচারণের তদন্ত করার ক্ষমতা এই কাউন্সিলের হাতেই থাকছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে প্রদান করা হয়েছিল। আদালত সংসদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণকে ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
রায়ে বলা হয়েছে, বিচারক অপসারণ ক্ষমতা যদি সংসদ সদস্যদের হাতে যায় তবে তার প্রভাব বিচার বিভাগে পড়বে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণে হাইকোর্ট যথাযথভাবেই এই সংশোধনীকে (১৬তম) সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেছে। এ সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে অন্য কোনো অভিমত দেওয়ার কারণ খুঁজে পাইনি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য যে দল থেকে নির্বাচিত হয়ে আসবে সেই দলের বিপক্ষে সংসদে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়। তাই বিচারক অপসারণে ভোটের ক্ষেতেও সংসদে দলের এই একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। এ অবস্থায় সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রদান যুক্তিসংগত হবে না বলেও আদালত মত দিয়েছেন।
রায়ে বলা হয়েছে, ৭০ অনুচ্ছেদ থাকার কারণে সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার স্বাধীনতা নেই কোনো সংসদ সদস্যের। এমনকি তার দল যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা নিদের্শনা দেয় তাহলেও তার বিরুদ্ধে ভোট বা মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা দলের নীতি নির্ধারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। ৭০ অনুচ্ছেদ বলবৎ থাকাবস্থায় বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে একজন বিচারককে দলীয় নীতিনির্ধারকের করুণা অনুযায়ী চলতে হবে। এ অভিমত দিতে আমরা কোনো ভুল দেখি না।
তবে হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের নিয়ে কিছু অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগ তুলেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত সেসব বক্তব্য রায় থেকে বাদ দিয়েছেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বলবত সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন যে দেশে বর্তমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বলবত নেই। এ অবস্থায় ১৬তম সংশোধনী বাতিল হলে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হবে। তার এ যুক্তি গ্রহণযোগ নয়। কারণ বর্তমান ব্যবস্থা বাতিল হলে আগের ব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা দ্রুত বলবত হবে। এখানে শূন্যতা সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই।’
রায়ে আরো বলা হয়, জনগণ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদকে দেয়নি। এটা সংবিধানের ৮৮(খ)(আ), ৮৯(১) এবং ৯৪(৪) অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আপিল শুনানি সাতজন বিচারপতি শুনেছিলেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সবাই ঐক্যমত হয়েছেন। আলাদা কেউ রায় দেননি। রায়ে শেষ অংশে যেটা বলা হয়েছে, সেটা হলো সর্ব সম্মতিক্রমে আপিলটাকে ডিসমিস করেছেন। সংবিধানের ৯৬ এর (২) থেকে (৭) পর্যন্ত পুনঃস্থাপন করেছেন এবং রায়ে বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে তার সঙ্গেও তারা একমত করেছেন। টোটাল বিষয়টি দাড়ালো যে মার্শাল আমলে সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভূক্ত করে সংশোধন করা হয়েছিল সেটিকে আবার পুনঃস্থাপন করা হলো।
তবে আদালত কর্তৃক এভাবে পুনঃস্থাপন প্রসঙ্গে মাহবুবে আলম বলেন, আমার বক্তব্য হলো সংবিধানের যে কোন ধারা সংশোধন করা বা বাদ দেওয়া সবটাই সংসদের ব্যাপার। কোর্ট যদি নিজেই রিস্টোর (পুনঃস্থাপন) করে দেয় তাহলে সংসদের থাকার কোন দরকার হয় না। আমার কথা হলো যে কোনো সংবিধানের যে কোনো সংশোধনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্ত সংবিধানের কোন ধারা পুনঃস্থাপন বা রিস্টোর করা আমার বিবেচনায় এটা সংসদের কাজ।
এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর হয়ে গেল কি না জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, এটা এই মূর্হতে বলা কঠিন ব্যাপার। এটা নিয়ে এই মুহূর্তে কোন কমেন্টস আমি করবো না।
রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিভিউ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
অপরদিকে রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের মতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এ রায়ের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপন হয়ে গেছে। অর্থাৎ, এখন থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারকের অপসারণ হবে।
আপিলের রায়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলার বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সাত বিচারপতির বেঞ্চের চারজনই প্রাসঙ্গিক না বিধায় এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। প্রধান বিচারপতিসহ তিনজন এটিকে সংবিধান পরিপন্থি বলেছেন।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। যিনি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন বলে সেখানে উল্লেখ আছে। ১৯৭২ সালে বিচারকদের এই শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব ছিল সুপ্রিম কোর্টের হাতে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ১১৬ তো কোন ইস্যু ছিল না। ইস্যু ছিল ৯৬ অনুচ্ছেদ।
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারনের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। আপিল বিভাগের রায়ে ৫ম সংশোধনী বাতিল হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাশ করা হয়। এরপর তা ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ পায়।
এ অবস্থায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। তিন বিচারকের মধ্যে দুইজন ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন এবং একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন।
এরমধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠদের রায় প্রকাশিত হয় গতবছর ১১ আগস্ট এবং রিট আবেদনটি খারিজ করে দেওয়া এক বিচারকের রায় প্রকাশিত হয় একইবছরের ৮ সেপ্টেম্বর। দুটি মিলে মোট ২শ ৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত ৩ জুলাই তা খারিজ করে দনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
(দ্য রিপোর্ট/কেআই/আগস্ট ০১, ২০১৭)