খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর
রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা কথা
১১ বছর আগে ক্ষমতা ছাড়ার পর তৃতীয় দফায় লন্ডন সফরে গেলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রায় দুই মাসের জন্য গত ১৫ জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। দলীয়ভাবে নিজ চিকিৎসা, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান এবং তার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা বলা হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ দেশের রাজনৈতিক মহল এ সফরকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তাদের ধারণা-পুত্রের উপস্থিতিতে কীভাবে দলকে গতিশীল করা যায়, আগামী জাতীয় সরকারের ফর্মুলা বা রূপরেখা আনতে তার এ সফর। আবার কেউ কেউ মনে করেন দেশের বিরুদ্ধে, রাজনীতির বিরুদ্ধে, উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে তিনি লন্ডন গেছেন। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরকে কেন্দ্র রাজনৈতিক অঙ্গনের চতুর্দিক এখন নানা মুখে নানা কথা চলছে।
দলীয় সূত্র জানায়, ১৬ জুলাই রোববার যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর পর হিথরো বিমানবন্দর থেকে প্রথমে হিলটন হোটেলে ওঠেন বেগম খালেদা জিয়া। সেখানে কয়েক ঘণ্টা অবস্থানের পর লন্ডনের কিংস্টনে পুত্র তারেক রহমানের বাসায় ওঠেন তিনি। ওই বাসায় তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জায়মা রহমান ছাড়াও প্রয়াত কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শার্মিলা রহমান সিঁথি ও তার দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান রয়েছেন। একাধিক মামলায় হুলিয়া মাথায় নিয়ে গত নয় বছর ধরে স্ত্রী-সন্তানসহ লন্ডনে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। খালেদা জিয়ার এবারের সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আওয়াল মিন্টু ও তার ছেলে দলের নির্বাহী সদস্য তাবিথ আওয়াল, একান্ত সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার ও গৃহকর্মী ফাতেমা আখতার। এ ছাড়া এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহামুদ চৌধুরী ও সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রমিন ফারহানা ঢাকা থেকে লন্ডন গেছেন। অন্যদিকে ইউরোপ, আমেরিকায় অবস্থানরত দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা নিজ উদ্যোগে লন্ডন গেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে।
এদিকে দলের পক্ষ থেকে এ সফরকে চোখ, পায়ের চিকিৎসা ও একান্ত ব্যক্তিগত দাবি করা হলেও সফর ও সফরসঙ্গীদেরকে নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি বিরোধী রাজনৈতিক মহল। ব্যক্তিগত সফরে দলীয় নেতারা যুক্ত থাকাটা সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা। এমনকি ১৭ জুলাই সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অনির্ধারিত আলোচনায় উঠে আসে খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর প্রসঙ্গ। বৈঠকে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরে আসা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত একজন সদস্য অনির্ধারিত আলোচনায় বলেন, উনি গেছেন, কিন্তু ফিরে আসবেন কি না কেউ জানেন না। সদস্যের এমন উক্তি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেখেন ফিরে আসে কি না।
একই দিনে সচিবালয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, শেখ হাসিনার মতো ওয়ান ইলেভেনের সময় সাহস করে খালেদা জিয়া দেশে ফিরে আসবেন কি না, মামলার ভয়ে আবার সময় বর্ধিত হবে কি না, তা কেবল সময় বলে দেবে।
আবার চিকিৎসা ও একান্ত ব্যক্তিগত সফরে দলীয় নেতাদের বহর কী কারণে তা-ও বিশ্লেষণ করছেন রাজনৈতিক দলের কেউ কেউ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এ সফরে চিকিৎসার চাইতে রাজনীতির পাল্লাটা যেন ভারী। একের পর এক ভুল আর একনাগাড়ে ১১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির রাজনৈতিক যে হাল হয়েছে, সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে তারা। কীভাবে সেই পথের সন্ধান করা যায় পুত্রের উপস্থিতিতে নেতাদেরকে নিয়ে আলোচনা করতেই হয়তো খালেদার লন্ডন সফর। নইলে ব্যক্তিগত সফরে দলীয় নেতাদের সফরসঙ্গী করবেন কেন! সংবাদ সম্মেলন ছাড়া চোখে পড়ার মতো দলীয় কর্মকাণ্ড না থাকলেও ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে দলের শীর্ষ পর্যায়ের তৎপরতা লক্ষণীয়। এরই মধ্যে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছেন। কিন্তু সহায়ক সরকারের রূপরেখা কী হবে তা এখনো স্পষ্ট করেননি তারা।
তাই, রাজনৈতিক মহল মনে করছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিছক চিকিৎসার জন্য নয়। বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এ সফরে অন্তর্ভুক্ত। হয়তো বা লন্ডন থেকে আসতে পারে নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা বা রূপরেখা। অন্যদিকে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর তালিকাও লন্ডনে চূড়ান্ত হতে পারে বলে দলের ভেতর ও দলের বাইরে অনেকের ধারণা। তাই, নিজ অবস্থানকে শক্ত করতে উঠতি ও তরুণসহ অনেক নেতা দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশে লন্ডনমুখী হচ্ছেন। তবে, যে যা-ই বলুন না কেন, দলের মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর লন্ডন সফরের বিষয়ে সব সমালোচনা নাকচ করে স্পষ্টভাবে বলে আসছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সফরটি নিজ চিকিৎসা ও একান্ত ব্যক্তিগত। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দলের চেয়ারপারসন পুত্র ও পরিবার পরিজনের সময় কাটিয়ে ও চিকিৎসা শেষে যথা সময়ে দেশে ফিরবেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানে বড় ছেলে তারেক রহমানসহ তার পরিবার এবং ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করেন তিনি। ৬৭ দিন পর আবার দেশে ফিরে আসেন খালেদা জিয়া। এর আগে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফেরার পথে পুত্রকে দেখতে লন্ডন গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
০৩/০৮/২০১৭