তুরস্কের এনজিও’র মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়ন
জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে গ্রেফতার মোস্তাক আহাম্মেদ খাঁ (২৭) তুরস্কের বিভিন্ন এনজিও, ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহ করত। এই অর্থ তুরস্ক থেকে বাংলাদেশে আসত দুটি এনজিও’র নামে। মুসলিম রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও’র সদস্য ছিলেন তিনি এবং আল কাউছার নামে তার নিজস্ব আরেকটি এনজিও ছিল। তুরস্কের বিভিন্ন ‘জঙ্গিবাদি’ সংগঠনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। সিআইডির তদন্তে এ সকল তথ্য উঠে আসে।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, ১০-১১ বছর আগে অবৈধভাবে তুরস্কে গিয়েছিল মোস্তাক আহাম্মেদ খাঁ । সেখান থেকেই জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িয়ে যায়। ৫-৬ বছর আগে মোস্তাক দেশে আসার পর থেকেই বাংলাদেশের দুটি জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িয়ে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন করে। কিন্তু তার এ কর্মকাণ্ডে কারও যাতে সন্দেহ না হয় সে জন্য তিনি এলাকার লোকজনকে অনেক দান করতেন। যাতে কেউ তার সম্পর্কে খারাপ কোন কিছু বলতে না পারে। মোস্তাক ঈদ-উল-আযহায় ৩-৪টি গরু কোরবানি করে এলাকার মানুষের মাঝে বিতরণ করত। রোহিঙ্গা ও এলাকার অন্য মুসলমানদের অর্থসহ নানাভাবে সহযোগিতা করত। তার হবিগঞ্জের বানিয়ারচরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. শাখায় ৯২.৭২ লাখ টাকা জমা পাওয়া যায়। এছাড়াও চট্টগ্রামের বন্দরটিলা, হালিশহর এবং কক্সবাজার থেকেও সে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে। হবিগঞ্জের ইসলামী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এমকে এন্টারপ্রাইজের নামে ১৯.৩০ লাখ টাকা তিনি জমা এবং ১৯.১৪ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালে জামায়াত-বিএনপি জোটের রাজনৈতিক সহিংসতার সময়ে মোস্তাক আহমেদ খাঁর প্রায় দুই কোটি টাকা সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ২০১৪ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোস্তাকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে তুরস্ক থেকে প্রায় এক কোটি ৮৬ লাখ টাকা আসে। এ সময়ে দেশবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনে টাকাগুলো বিনিয়োগ করেন তিনি। মোস্তাক আগে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিপুলসংখ্যক নাগরিক রয়েছেন, যাদের সঙ্গে মোস্তাকের যোগাযোগ ছিল।
তিনি আরও বলেন, মোস্তাক আনুমানিক ১০ বছর আগে অবৈধভাবে তুরস্কে যায় এবং ৫ বছর আগে ফেরত আসে। এরপর মোস্তাকের অনুমোদিত এনজিও ‘আল কাউছারের’ নামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে তুরস্ক থেকে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আসার প্রমাণ পেয়েছি আমরা। সে সব অর্থ রোহিঙ্গা মুসলিমদের সহযোগিতার নামে বিভিন্ন দেশবিরোধী কাজে ব্যয় করে মোস্তাক। মোস্তাকের ভাষ্যমতে, অর্থগুলো মুসলিমদের কল্যাণে দান করা হয়েছে। এ সব অর্থ তুরস্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরির নাম করে আনেন তিনি।
সিআইডি সূত্রে আরও জানা যায়, এলাকায় সুনামের কারণে পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে মোস্তাককে খুঁজলেও তাকে সনাক্ত করতে পারেনি। কারণ সকলেই তার অনেক সুনাম করত। হবিগঞ্জে দুই বছর আগে মোস্তাকের নামে সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলা হয়। কিন্তু তখন জেলা পুলিশের তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। পরে এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব আসে সিআইডির উপর। সিআইডি তদন্ত করতে গিয়ে সকল তথ্য খুঁজে বের করে। মোস্তাকের সহযোগী মো. কাউছার মিয়ার ব্র্যাক ব্যাংকের বানিয়ার চরের শাখার অ্যাকাউন্টে ও তার শাশুড়ি হামিদা খাতুনের অ্যাকাউন্টে দেশের বাইরে থেকে এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ এসে জমা হতো। এর আগেও মোস্তাকের বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ বেশকিছু মামলা ছিল। যে দুটি এনজিও’র নাম করে মোস্তাক তুরস্ক থেকে অর্থ সংগ্রহ করত, সে দুটি এনজিও’র কাছে অর্থের হিসেব চাওয়া হবে এবং তাদেরকেও তদন্তের আওতায় আনা হবে। তদন্তের এনজিও দুটির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্য মিললে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে মোস্তাকের বিরুদ্ধে দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া যায়। মামলার তদন্তের মাধ্যমে জানা যায়, বিভিন্ন থানায় তার নামে একাধিক মামলা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে থাকা টাকা লেনদেনের ব্যাপারে সদুত্তর দিতে না পারায় তার বিরুদ্ধে আগেই হবিগঞ্জ মডেল থানায় ২০১২ সালে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলাটি সিআইডিতে বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।
নতুন করে মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলায় মোস্তাককে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরো টাকা এসেছে কি না কিংবা সে কোথায় কোথায় অর্থায়ন করেছে। কোন কোন নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সঙ্গে সে জড়িত। সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলেও জানান বিশেষ পুলিশ সুপার।
এর আগে, সোমবার (০৭ আগস্ট) হবিগঞ্জ থেকে মোস্তাককে গ্রেফতার করে সিআইডি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী, বিস্ফোরকসহ ৫টি মামলা রয়েছে। সোমবার গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ সদর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে আরো একটি মামলা দায়ের করে সিআইডি।
(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/এপি/এনঅাই/আগস্ট ০৮, ২০১৭)