দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় আদালতের বিরাগ থেকেও হতে পারে বলে মনে করছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। সংসদ ও সরকারের প্রতি বিরাগ থেকে যদি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা এই রায় দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলেও মনে করছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

বিভিন্ন বিষয়ে সংসদ ও সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের টানাপড়েনের মধ্যেই সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় দেয় আপিল বিভাগ, যা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সিনহা বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। পর্যবেক্ষণে ‘বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে রায়ে ক্ষুব্ধ সরকারি দলের নেতারা কড়া সমালোচনা করছেন, বাক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সিনহাও।

এই রায়ের অন্যতম সমালোচনাকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক শনিবার (১৯ আগস্ট) এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা জজ সাহেবেরা কোনোদিনই অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু করব না। রায়ে যদি কোনো অনুরাগ বা বিরাগ রিফ্লেক্ট করে, তাহলে হোয়াট ইজ দ্য কনসিকোয়েন্স অব দ্যট জাজমেন্ট। থিঙ্ক অ্যাবাউট ইট। আমার বলার কিছু নেই।’

‘যে জজসাহেব অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে... যদি আপনারা অনুরাগ বা বিরাগ বলে মনে করেন আপনারা... যেগুলো আমি বললাম, ‘পার্লামেন্ট ইজ ইমম্যাচিওর’, ‘ডেমোক্রেসি ইজ ইমম্যাচিওর’, ‘পার্লামেন্ট আমাদের ডাইরেকশন শোনেনি’, এই কথাগুলো যদি অনুরাগ বিরাগের মধ্যে চলে আসে তাহলে সেই জজ সাহেবের পজিশনটাই বা কী হবে?

‘তিনি ওথ বাউন্ড থাকছেন কি না, সেটাও আপনারা বিচার- বিবেচনা করে দেখুন। আমি পয়েন্ট আউট করে দিলাম। ওথ ভঙ্গ হলে কী হতে পারে? আপনারা জানেন কী হতে পারে।’

ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘জাতীয় শোক দিবস, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতি শীর্ষক’ আলোচনা সভায় বিচারপতি খায়রুল হক তাকে নিয়ে সমালোচনার জবাবও দেন।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, তা অবৈধ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালতের রায়টি হয়। জিয়াউর রহমান আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলছে বিএনপি। সেই সঙ্গে দলটির নেতারা বিচারপতি খায়রুল হকের সমালোচনাও করছেন। তারা বলছেন, রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকার অযোগ্য হয়েছেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বিচারপতি খায়রুল হক আইন কমিশনের কাজের ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেন, যেহেতু আইন নিয়ে গবেষণা করা তাদের কাজ, সেহেতু আদালতের এই রায় তাদের গবেষণার বিষয়ের মধ্যেই পড়ে।

‘কথা উঠে আমি ল কমিশনের চাকরি করি। এখানে বসে এত কথা বলা উচিৎ কি না? তাদের হয়ত ল কমিশন সম্পর্কে কোনো আইডিয়া না থাকারই কথা। ল কমিশন কিন্তু এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে আইন নিয়েই আমাদের গবেষণা। আইনকে মনিটর করাও আমাদের আরেকটা কাজ।

‘উচ্চ আদালতের একটি রায় কিন্তু আইন। সেটা দেশের জন্য আইন। প্রধান বিচারপতি রায়ের মধ্যে যে সব কথা বলেছেন সেটা যদি বাইরে বলতেন, তাহলে হয়ত এত কথা উঠত না। কিন্তু রায়ের মধ্যে বলেছেন, তখন সেটা আইনের অংশ হয়ে গেছে, এ কারণেই এত আপত্তি।’

‘তিনি তার রায়ের মধ্যে সংসদকে অকার্যকর বলেছেন এটাই সর্বনাশী ব্যাপার। সে কারণে এটাতো আমাদের মনিটরিং করতে হবে, সেটা কারও পছন্দ হোক বা না হোক। ল কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।’

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে একটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু আছে। দ্বৈত শাসন মানে এ রকম যে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রমোশন বা বদলি সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাব জিএ কমিটি বা ফুল কমিটি বিচার বিবেচনা করে। হয় তাতে একমত হন অথবা দ্বিমত করেন।

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’

খায়রুল হক বলেন, ‘আমি মনে করি এই ব্যবস্থাটাই উত্তম। কারণ এখানে কোনো পক্ষেরই এক্সট্রিম কোনো কিছু করার সুযোগ নেই।’

সম্পূর্ণ ক্ষমতা সরকারের উপর থাকলে যেমন ‘কিছুটা অপব্যবহারের’ সুযোগ থাকে, তেমনি সুপ্রিম কোর্টের উপর থাকলেও একই ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

‘সুপ্রিম কোর্টে যে সমস্ত বিচারকগণ আছেন তারা কিন্তু ফেরেশতা না, তাদেরও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তাদেরও নানা রকম দুর্বলতা থাকতে পারে। নানা রকম সমস্যা থাকতে পারে। কাজেই এক হাতে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা না থাকাই ভালো বলে আমি মনে করি।’

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে সংসদকে অকার্যকর বলার সমালোচনা করেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান।

‘এখানে প্রধান বিচারপতি সংসদকে বলেছেন ‘ইমম্যাচিউরড’, এটা দুঃখজনক। আর্টিকেল ৬৫ (৩) অনুযায়ী মহিলাদের নির্বাচনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি। এটাই গণতন্ত্রের ম্যাচিউরিটি। কোনটা ম্যাচিউরড সেটা উনি (প্রধান বিচারপতি) বলার কে? কোনটা কী হবে, না হবে, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক হল সংসদ সদস্যরা, জুডিশিয়ারির নয়। এ বিষয়ে একজন বিচারপতি বলতে পারেন না।’

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘বলেছেন, ১৫২ জন ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেনি। তাহলে উনারা (বিচারপতিরা) কি ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন নাকি। এক জায়গায় উনি বলেছেন, সংসদ নির্দেশনা মানেনি। সংসদকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের নেই। সেই নির্দেশ যদি দিয়েও থাকে তাহলে তা মানতে সংসদ বাধ্য নয়। সংসদ হল সার্বভৌম।’

সংসদকে অকার্যকর বলা সুপ্রিম কোর্টের ভাষা হতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সাংসদ সদস্যরা আর কিছু না হোক, তারা জনগণের প্রতিনিধি। সেটাই তাদের প্রথম যোগ্যতা। একজন সংসদ সদস্যের ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে আপনি দেশের মানুষকে ভালবাসেন কিনা বা জনগণ আপনাকে ভালবাসে কি না?

‘সবাইকে যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হবে, এমন তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অবশ্য অনেকে সংসদ সদস্যই পিএইচডি ডিগ্রিধারী আছেন। ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও সব সময় অত বড় শিক্ষিত পার্লামেন্টারিয়ান পাওয়া যায় না। যদিও এটা অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট।’

ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় অ্যামিচি কিউরিদের মত নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিচারপতি খায়রুল হকের, যাদের একজন বাদে সবাই সংসদের হাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন।

‘এ রায়ে আট-নয়জন অ্যামিকাস কিউরিরা এটাকে সাপোর্ট করেছে। জোরেশোরে সাপোর্ট করেছে। তারা অত্যন্ত বিদ্বান লোক, বোদ্ধা মানুষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘এখন থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগের কথা। তখন আমি শিক্ষানবিশ আইনজীবী ছিলাম। আমার সিনিয়র আমাকে বলেছিল ‘যে দেবতা যে মন্ত্রে তুষ্ট, সেই দেবতাকে সেই মন্ত্রেই সুধাবা’। আমি কী বলেছি, আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন। অ্যামিকাস কিউরিদের সম্পর্কে বাকি কিছু বলার নেই।’ (সূত্র : বিডিনিউজ)

(দ্য রিপোর্ট/এজে/আগস্ট ১৯, ২০১৭)