দলিতদের মর্যাদায় ধর্মগুরুর পক্ষে উন্মাদনা
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ভারতে হরিয়ানার একটি বিশেষ আদালত শুক্রবার যে বিতর্কিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিংকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে, তিনি ১৯৯০ সালে ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন। তারপর থেকে সামনে এসেছে তাকে ঘিরে একের পর এক বিতর্ক। ধর্ষণ, গুম-খুন, হুমকি দেওয়া- নানা অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর আগেও প্রচারিত হয়েছে। খবর বিবিসির।
কিন্তু তার পরেও ডেরা সাচ্চা সৌদার এই লাখ লাখ ভক্তরা কেন তাদের গুরুর জন্য পাগল? কেন তারা গুলি-লাঠির পরোয়া না করে হাজারে হাজারে ভক্ত শুক্রবার রাস্তায় নেমেছিলেন, তান্ডব চালিয়েছেন দুটি রাজ্যজুড়ে?
পাঞ্জাব ট্রিবিউনের সিনিয়র সাংবাদিক হামির সিং বহুদিন ধরে গুরমিত রাম রহিম সিং ও তার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাজের সঙ্গে পরিচিত। তিনি বিবিসিকে বলেন, কীভাবে গুরমিত রাম রহিম সিং ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধানের দায়িত্ব পেলেন।
‘সেই সময়ে পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলন চলছিল। গুর্জন সিং রাজস্থানী নামে এক উগ্রপন্থী নেতা ছিলেন। এই গুরমিত হচ্ছেন গুর্জন সিংয়ের চাচাতো ভাই। মনে করা হয় গুর্জন সিং আর প্রাক্তন এক অতি ক্ষমতাবান পুলিশ প্রধান গুরমিতকে ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান হিসাবে বসানোর পেছনে নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন। ডেরার পুরনো প্রধান তখনও বেঁচে ছিলেন। তা সত্ত্বেও অনেক জমিজমার মালিক এই যুবক গুরমিতকে প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল,’ বলছিলেন হামির সিং।
তিনি যে সম্প্রদায়ের প্রধান, সেই ডেরা সাচ্চা সৌদার মতো আরও অনেক ডেরা আছে পাঞ্জাব হরিয়ানায়। মূলত শিখ ধর্মের একেক জন গুরুর অধীনে থাকে এইসব ডেরাগুলি।
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রৌণকী রাম বলছিলেন, ‘ডেরার প্রতি তাদের ভক্তদের একরকম অন্ধ বিশ্বাস তৈরি হয়। তারা মনে করতে থাকে তারা যা করছে, তাই ঠিক, সত্যের জন্য কাজ করছে তারা। ভক্তদের যে কোনওরকম সমস্যা ডেরাই সমাধান করে দেয়- তা জলের অভাব হোক বা অন্য কিছু। এককথায় ডেরায় সোশ্যাল ক্যাপিটাল তৈরি করা হয়। এমন কোনও ডেরা পাওয়া যাবে না যার নিজস্ব স্কুল, ক্যান্টিন, কোঅপারেটিভ মেস এসবের মতো প্রতিষ্ঠান নেই।’
তাঁর কথায়, যে কাজগুলো সরকারের বা নাগরিক সমাজের করার কথা ছিল, সেগুলোরই অভাব মেটায় এই ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ডেরাগুলো। তার ফলে ভক্তদের মনে এইসব ডেরার প্রধান, যাদের বাবা বলা হয়, তাদের প্রতি তৈরি হয় এক প্রশ্নহীন আনুগত্য।
আর তার ফলে ডেরাকে ঘিরে রাজনীতি আর গ্রামীণ সমাজ চলতে থাকে। সেগুলো হয়ে ওঠে সমান্তরাল শক্তি কেন্দ্র।
সাংবাদিক হামির সিং বলছিলেন, ‘পাঞ্জাব হরিয়ানার বেশিরভাগ ডেরাতেই জাঠ সম্প্রদায়ের আধিপত্য। সেখানে দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের কোনও জায়গা নেই অথচ তারা পাঞ্জাবের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ। কিন্তু এই ডেরা সাচ্চা সৌদার বেশিরভাগ ভক্তই দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ।’
‘তাঁরা অন্যান্য ডেরাগুলোয় কোনও প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না, তাদের কেউ পাত্তা দেয় না অথচ এই একটা ডেরায় তারাই সর্বেসর্বা। তাই এই ডেরার প্রতি অসীম আনুগত্য তাদের’ বলেছিলেন মি. সিং।
যতই ভক্ত বাড়তে লাগল গুরমিত রাম রহিম সিং-এর, তিনি আরও বেশি করে আনুগত্য আদায়ের জন্য দলিতদের বেশি করে জায়গা, মর্যাদা দিতে থাকলেন।
এজন্যই ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিং সহ সমস্ত ভক্তদের নামের শেষে ‘ইনসান’ অর্থাৎ মানুষ শব্দটা যোগ করা হল, যাতে দলিত ভক্তদের সামাজিক সম্মান দেওয়া যায়।
দলিতদের এই সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার কারণেই দ্রুত ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে গুরমিত রাম রহিম সিং-এর। তাঁর এই ভক্তকুলের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেখে ডেরায় যাতায়াত শুরু করেন রাজনৈতিক নেতারা।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান শমিত কর বলছেন, ‘ভারতের সমস্যাটা হল বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা হোক বা স্বাস্থ্য পরিষেবা- সব কিছুরই সিংহভাগ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তাই আদিম অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলোর প্রতি আর সেগুলো যারা প্রচার করে সেই সব গুরুদের প্রতি অন্ধবিশ্বাস জন্মায় তাদের।’
একদিকে সিনেমার হিরো, দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘ইনসান’-এর মর্যাদা দেওয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর পেশীশক্তি- এই সব কিছুর মিশেলেই প্রায় আড়াই দশক ধরে গড়ে উঠেছে গুরমিত রাম রহিম সিং-এর ভক্তকূল।
(দ্য রিপোর্ট/এপি/আগস্ট ২৬, ২০১৭)