দেবু মল্লিক, যশোর : আর দিন কয়েক পরেই পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। আর তার কয়েক দিন বাদেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজা। কিন্তু এই উৎসব দুইটিকে ঘিরে যশোরের ভবদহ পাড়ের লাখো মানুষের মনে কোন আনন্দ নেই। আছে উল্টো বিশাদের সূর। সর্বনাশা ভবদহের ‘নিষ্ঠুর পানি’ তাদের সব আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে। ঘরের মধ্যে পানি জমে থাকা এই অঞ্চলের লাখো মানুষ মাসাধিককাল ধরে রাস্তার উপর টোংঘর তুলে বসবাস করছেন। পানিতে তলিয়ে আছে ঈদগাঁ। একই কারণে শুরু হয়নি এই অঞ্চলের মন্দিগুলোতে প্রতিমা তৈরির তৎপরতা।

চলতি বছর জ্যৈষ্ঠে দুই দফা ভারী ভর্ষণে যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলায় একাংশের অধিকাংশ বিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পরে আঢ়ালের প্রবল বৃষ্টিতে এসব এলাকা পানিতে একাকার হয়ে যায়। পানি ঢুকে যাওয়ায় যশোরের তিন উপজেলার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শত শত পরিবার আশ্রয় নেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠা, উচু স্থান বা রাস্তার উপর। সেই থেকে লাখো মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে আছেন।

যশোর জেলা ত্রাণ ও পূর্নবাসন কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম জানান, যশোরের তিন উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেশবপুরে ৬৯ হাজার ২১৮ জন মানুষ পানিবন্ধি হয়ে আছে। মণিরামপুরে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৫৮ হাজার ১০০ জন। আর অভয়নগরে জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে ১১ হাজার মানুষ। সব মিলে জেলার তিন উপজেলায় এক লাখ ১৮ হাজার ৩৩৪ জন জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে তিন হাজার ৩৯৪টি পরিবারের ১৬ হাজার ৪৯৮ জন ৪২টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এবারের কয়েক দফা ভারী বৃষ্টিতে জেলার ২৪টি ইউনিয়নের ১২৫টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।

যশোর-কেশবপুর সড়কে আশ্রয় নেওয়া কেশবপুর উপজেলার মধ্যকূল গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ ইলিয়াস সরদার বলেন, ‘এক মাস আগে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে উঠেছি। আয় রোজগার নেই। খেয়ে না খেয়ে কোন মতে বেঁচে আছি। কবে বাড়ি ফিরতে পারবো তা জানি না। তাই ঈদের কোন আনন্দ নেই।’ একই গ্রামের সৈয়দ আলী বলেন, ‘আমাদের ঈদগাঁ এখনো দুই হাত পানির নিচে। গত বছরো এই অবস্থা ছিল। তখন রাস্তার উপর ঈদের নামাজ পড়েছিলাম। তবে ছেলে-মেয়েদের চাহিদা মতো কিছু কিনে দিতে পারিনি। এজন্য আমাদের কাছে ঈদ হয়ে উঠে নিরানন্দ।’

কেশবপুরের হরিহর নদীর তীরে বাড়ি শোভা দেবনাথের। তবে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে এখন তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে আশ্রয় নিয়েছেন কেশবপুর পাইলট স্কুলে। এই স্কুলে তার গ্রামের আরো ছয়টি হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। স্থানাভাবে এই সাত পরিবার এক সাথে রান্না করে খাচ্ছেন। আসছে পূজা নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। কারণ বাড়িতে এখনো মাজা সমান পানি। শোভা দেবনাথ বলেন, ‘গত বছর জলাবদ্ধতার কারণে তিন মাস রাস্তায় ছিলাম। মাস পাঁচেক আগে রাস্তা থেকে বাড়িতে গিয়েছি। এখনো সব ঘর সংস্কার কাজ শেষ হয়নি। এরই মধ্যে জল এসে সব পরিকল্পানা মাটি করে দিয়েছে। মন্দিরের মধ্যে জল। কি করে পূজা করবো? জলাবদ্ধতা আমাদের উৎসবের রং ফিকে করে দিয়েছে।

যশোর জেলা ইমাম পরিষদের সভাপতি মাওলানা আনারুল করিম বলেন, ‘জলাবদ্ধতার জন্য যশোরের তিনটি উপজেলায় বেশ কয়েকটি ঈদগাহে এবার ঈদের জামায়াত হবে না । তবে তারা গত বছরের মতো এবারও রাস্তা বা উচু কোন স্থানে নামাজ আদায় করবেন।’

যশোর জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দিপংকর দাস রতন বলেন, ‘গত বছরের মতো জেলার কেশবপুর, মণিরামপুর ও অভয়নগরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এখনো প্রায় ১০টি মন্দিরে পানি জমে আছে। এজন্য ওই মন্দিরগুলোতে পূজার আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া বাড়িতে পানি থাকায় অনেকে এখনো রাস্তার উপর অবস্থান করছেন। এজন্য তাদের পূজার উৎসব ম্লান হয়ে যাচ্ছে।’

(দ্য রিপোর্ট/এজে/আগস্ট ২৮, ২০১৭)