দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ক’দিন আগে সবাইকে শোকে ভাসিয়ে চলে গেলেন কিংবদন্তি অভিনেতা নায়ক রাজ রাজ্জাক। সেই শোক কাটতে না কাটতেই বুধবার সকালে এল আরেকটি দুঃসংবাদ। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের অন্যতম মহাতারকা আবদুল জব্বারও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দু’টি কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার। পাশাপাশি ছিল হৃদযন্ত্র ও প্রোস্টেটের সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় বুধবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই গুণী শিল্পীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। জন্ম দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের। আবদুল জব্বারের মৃত্যুসংবাদ তাই শোকে ভাসিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু সেই শোক-বেদনার দিনটিতেই দারুণ এক সুখবর এল খেলার ময়দান থেকে। সেই আনন্দ সংবাদের জন্ম দিলেন দেশের ক্রিকেটাররা। সাকিব-তামিমদের বদৌলতে মিরপুর শেরে-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে রচিত হয়েছে দেশের ক্রিকেটের নতুন এক ইতিহাস। সফরকারী অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজের প্রথম টেস্টে ২০ রানে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ; ক্রিকেটের সবচেয়ে সুসংগঠিত-শক্তিশালী দলটির বিপক্ষে প্রথম টেস্টে জয়ের ইতিহাস গড়েছে বাংলার দামাল ক্রিকেটাররা।

জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়াকে ২৬৫ রানের টার্গেট দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে আগের দিন ২ উইকেটে ১০৯ রান তুলেছিল অস্ট্রেলিয়ানরা। বুধবার সকালে তাই আত্মবিশ্বাসী হয়েই মাঠে নেমেছিল স্টিভেন স্মিথের দল। অন্যদিকে, ভালো খেলা উপহার দিয়েও হার এড়ানোর চাপ ছিল বাংলাদেশের উপর। কিন্তু বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান প্রথম ইনিংসের মতো এই ইনিংসেও বল হাতে জ্বলে উঠেন। ক্যারিয়ারের ১৯তম টেস্ট শতক হাঁকানো ডেভিড ওয়ার্নারকে আর বেশি দূর (১১২ রান) এগুতে দেননি তিনি। এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেলে অসি ওপেনারকে সাজঘরে ফেরত পাঠান সাকিব। এরপর অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্মিথকেও মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসে বন্দি করেন তিনি। সাকিবকে যোগ্য সহায়তা দিয়েছেন স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজ। উইকেটের অপর প্রান্ত থেকে তারাও উইকেট তুলেছেন।পিটার হ্যান্ডসকম্ব, অ্যাস্টন অ্যাগার ও জস হ্যাজলউডের উইকেট তিনটি নিজের দখলে নিয়েছেন তাইজুল। অন্যদিকে, নাথান লায়নের উইকেট নিজের করে নেন আগের দিন ম্যাট রেনসোর উইকেট নিয়ে ব্রেকথ্রু’র সূচনা করা মিরাজ। এর মাঝখানে লাঞ্চের পর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও ম্যাথু ওয়েডকে সাজঘরের পথ চিনিয়ে দেন সাকিব। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের তিন স্পিনারের ‘ঘূর্ণি জাদুতে’ ২৪৪ রানে থেমে যায় অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস; ২০ রানে ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ পায় ঐতিহাসিক এক জয়।

ব্যাটে-বলে অবদান রাখার সুবাদে প্রশ্নাতীতভাবে ম্যাচসেরা পুরস্কার সাকিবের হাতেই উঠেছে। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে করেছিলেন ৮৪ রান। বল হাতে দুই ইনিংসেই ৫টি করে উইকেট নিয়েছেন। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো টেস্টে দুই নূন্যতম ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব গড়লেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই উজ্জ্বলতম তারকা। ইতিহাসের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে একের অধিক টেস্টে একইসঙ্গে হাফসেঞ্চুরির বেশি রান ও ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন সাকিব। দু’টি টেস্টে এই কীর্তি সঙ্গী হয়েছে সাকিবের। বিরল এই রেকর্ডের অধিকারী অপর ক্রিকেটারটি হলেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক গ্রেট রিচার্ড হ্যাডলি (৩ বার)।

বাংলাদেশ এখন অব্দি যে ক’টি টেস্ট জিতেছে সেগুলোতে ঘুরে-ফিরে আসে সাকিব-তামিমের নাম। মিরপুর টেস্টে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সাকিবের পাশাপাশি এ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তামিম ইকবালেরও। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসেই দারুণ খেলেছেন। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৭১ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৮ রান। দু’জনই নিজেদের ৫০তম টেস্ট ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখলেন ঐতিহাসিক জয়ে।

সীমিত ওভারের ক্রিকেটের পাশাপাশি টেস্টে ক্রিকেটেও যে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, বুধবার অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর মধ্য দিয়ে যেন তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরবর্তী ১৬ বছরে (২০১৬ পর্যন্ত) যেখানে জিম্বাবুয়ে এবং দ্বিতীয় সারির ওয়েস্টইন্ডিজের বিপক্ষে পাওয়া জয়ই ছিল বাংলাদেশের ‘টেস্ট অর্জন’, সেখানে গত এক বছরের ব্যবধানে ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বিপক্ষে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। সাকিব-তামিম-মুশফিকরা যেন বুধবার অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে টেস্ট অঙ্গনে নিজেদের মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াবার বার্তাটা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন নতুন করে।

সাকিব-তামিমরা যেভাবে বিশ্বমঞ্চে দেশকে সম্মানের আসরের বসিয়ে চলেছেন, কে জানে, আব্দুল জব্বার বেঁচে থাকলে একদিন হয়তো বাংলার এই দামাল ক্রিকেটারদের সম্মানেও তিনি গাইতেন কোনো হৃদয়ছোঁয়া গান!

(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/আগস্ট ৩০, ২০১৭)