চিরশ্রী দেবনাথের কবিতা
[কবি পরিচিতি: চিরশ্রী দেবনাথের, জন্ম১৯৭৯ এর ১২ ফেব্রুয়ারি উত্তরপূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাসহর নামের একটি ছোট শহরে। বাবা রাধাগোবিন্দ মজুমদার সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন এবং মা মায়ারাণী মজুমদার। দুজনেই প্রয়াত। তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন। ছোটবেলা থেকেই লিখতে ভালবাসেন, ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি। বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে ও দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখেন। পেয়েছেন ত্রিপুরা সরকারের অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছোট গল্প পুরস্কার, স্রোত সাহিত্য প্রকাশনার ছোটগল্প পুরস্কার, ত্রিপুরা সরকার তথ্য আয়োগ দপ্তর কর্তৃক আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার। কবিতা ভালবাসেন তাই লিখে যেতে চান। কবিতায় নিজের কথা, মেয়েদের কথা বলতে ভালবাসেন।কবির প্রথম কবিতার বই দুইহাজার ষোলতে আগরতলা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে । বইয়ের নাম "জলবিকেলে মেঘের ছায়া "। প্রকাশক সতন্ত্র মেধা। ত্রিপুরার স্রোত প্রকাশনা সংস্থা থেকে, দুইহাজার সতেরোতে প্রকাশিত হয়েছে, লেখিকার দ্বিতীয় কবিতার বই"ঋতুক্ষরণের রোদ চশমায় "।]
ঝাউবনেরকাছে
এক.
ক্রমাগত সম্পর্কেরা ঝাউগাছের মতো তির তির
শীতকাল...কেড়ে নেয় পাখির অভিমান,
দুর্বার ধান্যক্ষেতে ঝরে পড়ে কথার মিছিল
শয্যা চায়নি তারা, চেয়েছে ভার, লঘুকথা,
সবুজাভ সময় ছুটে গেছে জ্যামুক্ত তীরের মতো
জঙ্ঘায় ভীর করে এসেছে শ্বেতদাগ, বরফের ঘরবাড়ি...
দুই
নবীনতর হওয়ার আগে আমি ছাল খসাই,
যেখানে লেখা আছে পড়ন্ত বিপ্লবের শ্লোগান এবং উৎসব।
আমি নিমন্ত্রণ পেয়েছি সব মরুভূমির স্বরলিপিতে,
আচ্ছন্ন বনভূমির প্রেম নিয়ে আমার দিকে ছুটে এসেছে,
আস্তো এক অ্যাসাইলাম, একটি ওরফ্যান হাউস,
এখানে ঘোর লাগা সম্পর্কে মানুষ ঘুরে ঘুরে ফিরে,
তারপর বিষাদে, নিশ্চুপে, জীবন্ত কোমায় ডুবে যায়।
জেগে থাকে চোখ এবং চিৎকার ...
তিন.
বিরহে সম্পর্কেরা দলিত মথিত হয়
পথ জুরে যেন রচিত হয় ঝড়ো শালবীথিকা
নিমন্ত্রণ রেখে যায় ছায়ার দল
ফিরে আসে ফিরে আসে সেই ঢেউ
বলে যায় বিরহেই সব ঠিক ছিল, সব আলো জ্বলে উঠে বিচ্ছেদে ...
চার
বড়ো ছোটভাবে ভাবি সব
ঘরবাড়ি, জানালা, দরোজায় থেমে থাকি
বেলাভূমি... বারান্দা পেরোয় না
চায়ের কাপে চা ঢালাতেই থেমে থাকে জলপ্রপাত
একপলক দখিনা বাতাসেই টর্নেডো
আকাশগঙ্গা ছেয়ে থাকে ছাদে
কিছু অবেলাকেই মরুভূমি ভাবি, ভাবি ক্যাকটাসের বন
সৌন্দর্য্য গন্ধ আমাকে গল্প বলে প্রতিবেশীর
চেনা পথঘাট কেন যে অরণ্য মনে হয় না?
তাহলে বেশ তো থাকতাম বন্য হয়ে,
গলার কাছে জমে উঠতো আরণ্যক সম্পর্ক, আবরণহীন ...
পাঁচ
মুক্ত হাওয়া এলো অবশেষে
ভাসতে ভয় ছিলো না,
ভাসানের জলে ভেসে থাকা কাঠামোকে ভয় পাই
একটি একটি ঋতু পেরিয়ে কাঠামোকে দিই অস্থি, মাংস, মজ্জা,
গুঁজে দিই অসুখের আঙরাখা
এই অবারিত ধুলো বাতাস উড়িয়ে নিচ্ছে জমে থাকা ভার
শৌখিন মোমবাতি নক্সায় জেগে ওঠে আত্মরতি
তারপরই কি সেই ক্লান্তি...দিনে ভেসে যাওয়া ..
ভাত
আজ লিখবো বলে বসিনি, নয়নতারা ভেসে যাওয়া রাত।
পাড়ার রাস্তা শুনশান, সাইনবোর্ডে সতর্কবার্তা গুটকা, খৈনী,
ক্যান্সার ছুঁয়ে দেয়, প্রতিবেশীর বাড়ি, বৈষ্ণবের কন্ঠে ছেঁড়া সুর।
মনে হয়, সব বাড়ি ভরা ছিল, সময়ই হাত মিলিয়ে নিয়ে
এসেছে নিঃসঙ্গতা, দেয়ালে ছাই রঙ।
সিঁড়িতে জল পড়ে, পড়তেই থাকে, ছবিগুলো দগদগে হয়ে ওঠে,
শববাহী গাড়ির চালক গ্যারাজে গাড়ি রাখে, দিনের সঞ্চয়,
আশ্চর্য স্নান শেষে, সব বৈরাগ্যকে তুড়ি মেরে ভাত খায়।
মাংস গন্ধে একটি হাসি... কারো কথা বলে না।
মৃত পাখিরা
একটি হিজাব এবং ওড়নার মধ্যে খানিকটা পার্থক্য, ...প্রেমের
হিজাব নিয়ে কোনও গান নেই, চুপ!
ওড়না উড়িয়ে, দোপাট্টা ভিজিয়ে যখন তখন বৃষ্টি ঝরে,
মেঘ জমে ওঠে অকাল ঋতুতে, রামধনু অসময়ের।
এই ছোট্ট শহরের ছোট্টবেলা থেকে আসা দোকানে,
আগে কোনো হিজাব বিক্রি হতো না,এখন প্রচুর!
ঝলমলে হিজাবগুলো সার দিয়ে ঝোলানো, মৃত পাখিদের মতো।
যাদের ভালো লাগে তারা পরুন।
আমার মনে হয়,
তাদের চুলে, গলায়, কাঁধে একটু কি হলকা বাতাস
বয়ে যেতে পারে না, একটি অনাবৃত বনাঞ্চল।
এ পৃথিবীর ধুলোটিও তো, নরম, তারও একটু
ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে,
বন্দী ঋতুটির বড়ই ছটফটে স্বভাব।