বিষয়গুলো ভিন্নভাবে কি দেখা যায়?
আর রাজী
[সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে মিশেল ফুকোর একটি নিবন্ধ থেকে চুরির অভিযোগ উঠেছে। ‘আ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্টাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোস্যাল সায়েন্স রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু চুরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ১৯৮২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’র ৪নং ভলিউমে ফুকোর ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
যদিও সামিয়া তা অস্বীকার করে এর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়েছেন শিক্ষক মারজানের ওপর। আর মারজান বলছেন, তার ওপর দায় চাপাতে চাচ্ছেন সামিয়া। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিষয়টি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।নানাভাবে সবাই তাদের মতামত অথবা পোস্ট দিচ্ছেন ফেসবুকে। তেমনই একটি মত প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের শিক্ষক আর রাজী। গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা তার সেই মতামত এখানে হুবহু পত্রস্থ করলাম। বা.স]
এক.
আমি, এই সামান্য মানুষ; সাক্ষ্য দিতে পারি যে, আজতক আমি যতো মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি তাঁদের মধ্যে অন্যতম "ভাল মানুষ" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যার। বাংলাদেশের সার্বিক সততার মান বিবেচনা করে আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি, তিনি অত্যন্ত উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতার একজন অনুসরণীয় মানুষ। এমন মানুষকে ছোট করার যে কোনো চেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ধিক্কারযোগ্য। আরেফিন স্যারের সাথে সামিয়া রহমানের যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে, সেই ছবিতে সামিয়া ম্যামের বাবা (যিনি আরেফিন স্যারের বাম পাশে দাঁড়িয়ে) আছেন। ছবির পরিচিতি বর্ণনায় তা গোপন করা চূড়ান্ত অসততার নিদর্শন বলে আমার রায়।
দুই.
এই মুহূর্তে "সমালোচিত" সামিয়া রহমান সম্পর্কে, বিদ্যায়তনের বাইরের এবং আমার প্রান্তীয় পরিচিতজনদের বিপুল কৌতূহল মেটানোর জন্য সহজ করে দু'টি প্রসঙ্গে যে কথা বলতে চাই, তা নিম্নরূপ:
সামিয়া রহমানের কাজ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা তদন্তাধীন। প্রশ্ন উঠলেই কাউকে দোষী বলা যায় না। আর একটা কথা: কে, কার বিষয়ে, কখন, কী প্রশ্ন তুলছে সেসব নিয়েও এ দেশে সন্দেহ করার অবকাশ বিপুল।
নিবন্ধকারদের নিয়ে ওঠা "প্রশ্ন" প্রাথমিক পর্যায়েই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আসার কথা না।
নিবন্ধ জমা হলে প্রথম পর্যায়ে নিবন্ধটি অন্তত দু'জন স্বাধীন রিভিউয়ার বা পর্যালোচনাকারী নিরীক্ষা ও মূল্যায়ন করে তা প্রকাশযোগ্য কি না সে রায় দেন। উল্লেখ্য, লেখকদের পরিচয় রিভিউকারীদের কাছে গোপন রাখা হয়।
এর পরের ধাপে আছেন সম্পাদনার দায়িত্ব-সংশ্লিষ্টরা। যিনি বা যারা সম্পাদনা পর্ষদে ছিলেন, তাদের দায়িত্ব, লেখার সার্বিক মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে লেখককেও সুরক্ষা দেওয়া । তারাও কেন ওই নিবন্ধের "বিচ্যূতি" ধরতে পারেন নি?
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কেন নিবন্ধের ত্রুটি ধরা পড়লো না? নিবন্ধ প্রকাশযোগ্য হলে কেন প্রয়োজনীয় ত্রুটি সংশোধন করার জন্য লেখকদের কাছে ফেরত পাঠানো হলো না? কেন যথাযথভাবে নিষ্পন্ন নয়, এমন নিবন্ধ প্রকাশ করা হলো? এটি যে দূরভিসন্ধিজাত নয় তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে?
সাংবাদিক বন্ধুরা; স্মরণ করুন, সংবাদমাধ্যমে ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ কিছু প্রচারিত-প্রকাশিত হলে, সম্পাদককে দায়িত্ব নিতেই হয়। তারপর সহকারী-সম্পাদক, বার্তা-সম্পাদক বা সহ-সম্পাদক যারা থাকেন তাদের দায়-দায়িত্ব বিচার-বিবেচনা করা হয়। সব শেষে, লেখক বা সাংবাদিকের শাস্তির বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটার কথা।
যেহেতু আমি নিবন্ধ রিভিউ করার কাজটি করেছি, সে আলোকে পুরো বিষয়টিকে নিজের দিক থেকে দেখতে চাই। বলতে চাই যে, যারা ওই নিবন্ধ রিভিউ করেছেন, যারা ওই জার্নাল সম্পাদনা করেছেন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করার কারণেই বরং লেখক/রা তো বটেই, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও বিপুল সম্মানহানীর সম্মুখীন।
ব্যবস্থাপনার ত্রুটি অনুসন্ধান না করে, কর্মচারী/দের কাজ নিয়ে "প্রশ্ন" ওঠা মাত্র, নিজেদের পরিমণ্ডলের বাইরে তা প্রচারের উদ্যোগ অবশ্যই অস্বাভাবিক। তদন্ত, বিচার ও দোষ নির্ধারণের আগেই জনসম্মুখে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় যারা হাজির করেছেন, তারা খারাপ উদ্দেশ্যে, বদ কাজ করেছেন। ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার, সম্মানের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার, বিচারের আগেই ধূলিসাৎ করেছেন।
তিন.
সামিয়া রহমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে টিভিতে কাজ করা নিয়ে আপত্তি থাকলে প্রথমে তা উত্থাপিত হবে তার বিভাগে। বিভাগ যদি মনে করে, বিভাগ সামিয়া রহমানের কাছ থেকে যথাযথ সেবা/সার্ভিস পাচ্ছে না, বা তিনি বাইরে কাজ করায় বিভাগ বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে বিভাগ তাকে সেই মোতাবেক নির্দেশ/পরামর্শ দিতে পারে বা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট পর্ষদে তুলতে পারে। উনি যেহেতু প্রকাশ্য কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন, সুতরাং এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বিভাগ/প্রশাসন তা তাকে জানাতে ও সতর্ক করতে পারে। যদি তিনি তা না মানেন, তাহলেই কেবল তাকে শাস্তি দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠতে পারে।
এই বিষয়টিও আমি ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে চাই। সামিয়া রহমান গোপনে কোনো কাজ করেননি। যা করেছেন সব প্রকাশ্যে, টিভিতে করেছেন। তার শিক্ষা ও পাঠদান কাজের সাথে যায় এমন কাজই করেছেন। সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট কাজ করেছেন। তত্ত্বীয় কাজের পাশাপাশি, ব্যবহারিক কাজের যোগ্যতা উনি নিজের উদ্যোগে বৃদ্ধি করে চলেছেন। দেশের সাংবাদিকতা তাতে উপকৃত হওয়ারই কথা। বিভাগেরও তাতে উপকৃত হওয়ার কথা। তার ব্যবহারিক দক্ষতা বরং প্রশংসাযোগ্য।
শেষ কথা:
বিষয়গুলোকে এভাবেও কি দেখা যায়?