এরদোগানের ইরান সফর: কী প্রভাব পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যে?
সিরাজুল ইসলাম, তেহরান থেকে : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান গত বুধবার ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফর করেছেন। তার এ সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে- গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং কৌশলগত সামরিক বলয়ে বড় রকমের যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এরদোগানের এ সফরের কারণে তা ত্বরান্বিত হবে।
ইরান ও তুরস্ক হচ্ছে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। দু দেশের রয়েছে অভিন্ন সীমান্ত। দু দেশের ভেতরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেকটা কাছাকাছি, এমনকী ইরান ও তুরস্কে বহু নাগরিকের ভাষাগত অভিন্নতা রয়েছে। ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যে কুর্দি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে তাদের ভাষা আর তুরস্কের কুর্দি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি এক এবং অভিন্ন। তুরস্কের সঙ্গে ইরানের যত বেশী সীমান্ত বাণিজ্য চলে এত বেশি অন্য কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সঙ্গে চলে না। দুটো দেশই এ অঞ্চলের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বাহক। দুটো দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থানের ওপর এ অঞ্চলের অনেক কিছু নির্ভর করে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে সিরিয়া ইস্যুতে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে বড় রকমের মতপার্থক্য চলে আসছিল। ফলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যতটা উষ্ণ সম্পর্ক হতে পারত বা থাকা উচিত তা ছিল না। অবশ্য, এ কথা ঠিক যে, ইরান যেহেতু কূটনৈতিকভাবে খুবই ‘ম্যাচিউরড’ দেশ সে কারণে নিকটতম এই প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক কখনো তলানিতে নিয়ে যায় নি।
সিরিয়ায় আইএসআইএল এবং নুসরা ফ্রন্টসহ উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত বিস্তর মতপার্থক্য ছিল। এমনকী, সিরিয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যখন ইরান, রাশিয়া ও লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ এক জোটে থেকে লড়ে যাচ্ছিল তখন রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করেছিল এরদোগানের তুরস্ক। সে ঘটনায় রাশিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ পাইলট নিহত হন এবং এক পাইলটকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইরানের আল-কুদস ব্রিগেডের বিখ্যাত সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে যেখানে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে ইরান সেখানে এরদোগান সরকারের নীতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার সরাসরি ঘোষণা দেন এরদোগান।
সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে কিন্তু ইরান পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা চেষ্টা করে। ইরান অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে-সুস্থে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং সিরিয়ায় তার সামরিক পরামর্শমূলক কার্যক্রম ঠিক রাখে। ইরান সে সময় তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক কোনেভাবেই চরম অবনতির দিকে নিতে চায় নি এ কারণে যে, তুরস্ক শুধু ইরানের প্রতিবেশী নয়, সিরিয়ারও প্রধান প্রতিবেশী। সিরিয়ার প্রায় পুরো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত তুরস্কের সঙ্গে লাগোয়া। সিরিয়া যুদ্ধে যদি বড় রকমের সাফল্য অর্জন করতে হয় তাহলে তুরস্ককে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এ কৌশলে ইরান ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে এবং তুরস্ককে ধীরে ধীরে এক কাতারে আনার চেষ্টা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক রাজনীতিতে তুরস্ককে দিয়ে যে ‘কার্ড খেলানো’ সম্ভব অন্য কাউকে দিয়ে তা সম্ভব নয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তুরস্ক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশটি একদিকে যেমন ন্যাটোর সদস্য তেমনি আরেকদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার কিন্তু অর্থনীতিটা বেশ সবল। নানা দিক বিচার করে এ কথা বলতেই হবে- তুরস্ক এ অঞ্চলের রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ‘প্লেয়ার’। কিন্তু সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার কারণে এবং বাশার আসাদ সরকারকে উৎখাত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি আরব দেশ ও পশ্চিমা সরকারগুলো সঙ্গে অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ করার কারণে আংকারার সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক ততটা মধুর সময় পার করছিল না। তবে ইরান হাল ছাড়ে নি। ইরানের সরকার ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। তারই ফলাফল আজকের ইরান-তুরস্ক সম্পর্ক; এরই ধারাবাহিকতায় এরদোগানের ইরান সফর। এবং এখানেই লুকিয়ে আছে ইরানের কূটনীতির অনন্য বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। সারা বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো যেখানে কূটনীতির পরিবর্তে যুদ্ধ ও ডামাডোলের মাধ্যমে একে অপরকে বশীভূত করা চেষ্টা করছে, সেখানে ইরান তার প্রতিরোধমূলক নীতি বজায় রেখেও কূটনৈতিক শক্তি দিয়ে শত্রুকে বন্ধু বানানোর কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। যোগাযোগের এটাই তো মূল কথা!
এরদোগানের ইরান সফরের গুরুত্বটা বোঝা যাবে তার সফর সঙ্গী ও প্রতিনিধিদলের দিকে নজর দিলে। বুধবার যখন তিনি তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান তখন তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসওগ্লু, অর্থমন্ত্রী নিহাত জেইবেকচি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদমন্ত্রী বেরাত আলবেইরাক, বাণিজ্যমন্ত্রী বুলেন্ত তুফেঙ্কচি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোলায়মান সইলু, সংস্কৃতি ও পর্যটনমন্ত্রী নুমান কুরতুলমুস এবং ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টির পররাষ্ট্র বিষয়ক ডেপুটি চেয়ারম্যান মেহমেত মেহদি একের। এই তালিকায় নজর দিলে দেখা যায়, তুরস্কের প্রায় পুরো মন্ত্রীসভাকে নিয়ে এরদোগান ইরান সফরে এসেছিলেন।
সফরের ফলাফল কী হবে?:তুর্কি প্রেসিডেন্টের ইরান সফরের গুরুত্ব সম্পর্কে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সফর ইরান ও তুরস্কের মধ্যে সহযোগিতার নতুন অধ্যায় রচনা করবে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে এ সফরকে সমসমায়িক রাজনীতির অঙ্গনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এরদোগানের এ সফরের যেমন রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত গুরুত্ব।
তেহরান পৌঁছেই এরদোগান একটা অসন্তুষ্টির কথা জানান। তিনি বলেন, ইরান ও তুরস্কের মধ্যে বার্ষিক মাত্র এক হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য থাকা উচিত নয়। দু দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ অন্তত তিন হাজার কোটি ডলার হওয়া উচিত। এ জন্য দু দেশ বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, তুর্কি ব্যবসায়ীদের জন্য ইরানের বিনিয়োগ ক্ষেত্র উন্মুক্ত রয়েছে। পাশাপাশি দু দেশ নিজস্ব মুদ্রায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে যা ইরানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পরমাণু সমঝোতা চুক্তির পরও যখন তেহরান বাণিজ্যিক লেনদেনে অঘোষিত বাধার মুখে পড়ছে তখন স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন ইরানের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া, ইরান ও তুরস্ক যেহেতু বিশেষ করে মুসলিম সভ্যতায় সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐত্যিহের দেশ সে কারণে দু দেশের মধ্যে পর্যটন খাতে সহযোগিতারও আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এ বিষয়ে তেহরান ও আংকারার মধ্যে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে- ইরানের বিশাল খনিজসম্পদে তুরস্কের বিনিয়োগ ও অংশগ্রহণ বাড়বে। এমনটি হলে দু দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হবে এবং দুই দেশের সামনেই অর্থনীতির বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব: এমন সময় এরদোগান তেহরান সফর করলেন যখন মধ্যপ্রাচ্যে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল ’র বর্বরতার কলংকিত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করতে চাইছে। এই কালো অধ্যায় হচ্ছে- ইরাকের উত্তরাঞ্চল থেকে আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র। ইরাক থেকে কুর্দিস্তানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। বিষয়টি নিয়ে আলাদা একটি কলাম লেখার ইচ্ছে রয়েছে। এখানে স্বল্প পরিসরে শুধু বলে রাখি- কুর্দিস্তান কেবলমাত্র ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; এটা ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়ারও বিষয় বটে। চার দেশ মিলে যে কুর্দি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে তার সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ইরাকের কুর্দিস্তানকে আলাদা করতে পারলে আস্তে আস্তে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরানের কুর্দি জনগোষ্ঠীকেও বিচ্ছিন্নতার দিকে টেনে নেবে। এ কাজে সফল হলে কুর্দিস্তান হবে ইহুদিবাদী ইসরাইল ও আমেরিকার জন্য মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ‘ছড়ি ঘোরানোর নতুন কেন্দ্র’।
সিরিয়া ও ইরাকে যখন উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল ’র পতন হতে যাচ্ছে তখন নতুন করে ইসরাইল ও আমেরিকা এই প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এতে সম্মতি রয়েছে সৌদি আরবসহ আমেরিকা এবং ইসরাইলের ঘোষিত ও অঘোষিত কিছু মিত্র দেশের। সিরিয়া ও ইরাককে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সবরকম প্রচেষ্ট যখন ব্যর্থ হতে চলেছে তখন কুর্দিস্তানকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র করছে এসব দেশ। প্রকৃতপক্ষে, তারা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা চায় না। ইরানের দুই প্রতিবেশী দেশ ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে ধীরে ধীরে ইরানকে বিচ্ছন্ন ও দুর্বল করে ফেলার প্রজেক্ট ছিল তাদের হাতে। সে প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়েছে। এরপর ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে দেশ দুটি দখলে নিয়ে ইরানকে ঘায়েল করার প্রকল্প ছিল কিন্তু সে চক্রান্তও ব্যর্থ হতে চলেছে। তবে, ইসরাইল-আমেরিকা নাছোড়বান্দার মতো লেগে রয়েছে তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নতুন করে কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা।
সবকিছু ঠিক থাকলে খুব শিগগিরি উগ্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএসআইএল মুক্ত হবে ইরাক। সেজন্য ইরাকের কুর্দিস্তানকে বেছে নেয়া হয়েছে এবং বিষয়টি ইরানসহ সব প্রতিবেশী দেশকে প্রভাবিত করবে। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে তুরস্ক। কারণ তুরস্কে রয়েছে মোট কুর্দি জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের দুই ভাগ। সেখানে কুর্দিরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য আন্দোলনও করছে। এ অবস্থায় ইরাকের কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমস্বরে রুখে দাঁড়িয়েছে ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্ক। এ জন্য ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ বাকেরি গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট তুরস্ক সফর করেছেন। তারপর তুর্কি সেনাপ্রধান পহেলা অক্টোবর ইরান সফরে আসেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইরান সফরে আসার তিনদিন আগে তিনি এ সফর করেন। এসব সফরের সময় দু পক্ষই পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র মেনে নেবে না সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করা হবে বলেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সীমান্তে ইরান ও তুরস্কের সামরিক বাহিনীর যৌথ মহড়া হয়েছে। একইভাবে ইরাকের সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও সেনা মহড়া চালিয়েছে ইরান। ওদিকে ইরাক ও তুরস্কের সেনারা যৌথ মহড়া চালিয়েছে। এসব মহড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল- কুর্দিস্তানকে এই বার্তা দেয়া যে, এসব দেশ কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্নতা মেনে নেবে না। ইরান পশ্চিম সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মোতায়েন করেছে।
ইরান সফরে এসে এরদোগান এ বিষয়ে বলেছেন, কুর্দি নেতারা ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে কুর্দিস্তানকে ভাগ করার পরিকল্পনা করছে- এটা মানা যায় না। অথচ ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক রয়েছে। এরদোগানের এ বক্তব্য থেকে আপাতত একথা পরিষ্কার হচ্ছে যে, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও জাতীয় ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ছাড় দেবেন না এরদোগান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও অন্য কর্মকর্তারা একইভাবে বলেছেন- কুর্দিস্তান হচ্ছে ইসরাইলি প্রজেক্ট; এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। চারটি দেশের মাঝখানে আরেকটি ‘ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া হবে না।
এরদোগানের এই সফরের মাঝ দিয়ে সিরিয়া ইস্যুতে ইরান ও তুরস্কের মধ্যকার দূরত্ব নিরসন হয়েছে বলে মনে করা যায়। এ আগে দু দেশ সিরিয়া ইস্যুতে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় ছয়টি বৈঠক করেছে এবং সিরিয়ার ভেতরে চারটি যুদ্ধমুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হয়েছে। সেসব বৈঠকে রাশিয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এছাড়া, এরদোগান ইরান সফরে আসার আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তুরস্ক সফর করেছেন। এ সব সফরই এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সিরিয়া ইস্যুতে তুরস্ক তার নিজের ভুল শুধরে আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে আগ্রহী। তা না হলে কুর্দি ইস্যুতে ইসরাইল ও আমেরিকা যে ভূমিকা নিয়েছে তা দেশটির একার পক্ষে ঠেকানো কঠিন হবে। এছাড়া, কাতার ইস্যুতে দোহার পক্ষ নেয়ায় সৌদি আরব ক্ষিপ্ত হয়েছে তুরস্কের ওপর। কুর্দি ইস্যুর মাধ্যমে তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে সৌদি আরব -তা খুব সাধারণ হিসাব। পাশাপাশি কাতার ইস্যুতে ইরান ও তুরস্ক এক লাইনে রয়েছে এবং ইরানের সড়ক পথ ব্যবহার করে অনেক কম খরচে ও স্বল্প সময়ে তুরস্ক কাতারে নানা পণ্য পাঠাচ্ছে। ফলে সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনায় তুর্কি সরকারের সামনে ইরান ও তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার বিকল্প নেই। সে কারণে সফরের সময় ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাতে তেহরান ও আঙ্কারাকে নিয়ে একটি শক্তিশালী জোট গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেন রজব তাইয়্যেব এরদোগান। তিনি বলেন, ইরাক থেকে কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকাতে তেহরান, আঙ্কারা ও বাগদাদকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে হবে। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠকের সময়ও। এখানে আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখি, রজব তাইয়্যেব এরদোগানের ইরান সফরের পরদিনই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, সে দেশের সেনাপ্রধান শিগগিরি ইরান সফরে আসবেন। এ বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইরানের সঙ্গে শক্তিশালী যে জোট গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তা যদি ঠিক থাকে তাহলে এ জোট বৃহত্তর রূপ নেবে এবং ধীরে ধীরে তাতে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ও লেবানন যোগ দিতে পারে। জোটের পরিধি আরো বেড়ে চীনও অংশীদার হবে। সম্ভবত আফগানিস্তানও বাইরে থাকতে পারবে না। এদিক থেকে কাতার, ওমান, ইয়েমেন চলে আসবে। কুয়েতও হেলে পড়তে পারে এ জোটের দিকে। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই কুয়েত ও ওমান সৌদি আরবের প্রভাব বলয় থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। দুটি দেশই পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সদস্য কিন্তু তারা সৌদি আরবের সব কথায় সাড়া দিচ্ছে না। কাতার ইস্যুতে তারা সৌদি ডাকে সাড়া দিয়ে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নি। ওপাশে পাকিস্তানও একই ভূমিকা পালন করে চলেছে গত কয়েক বছর। সব মিলিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এই সফরের পর সত্যিই যদি ইরান ও তুরস্ক শক্তিশালী জোট গঠনের পথে এগিয়ে যায় তাহলে সে জোটে চূড়ান্তভাবে সুদুর চীন থেকে শুরু করে রাশিয়ার বিশাল অঞ্চল হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী দেশগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে বৃহত্তর জোট। সেখানে অর্থনীতি যেমন গুরুত্ব পাবে তেমনি সামরিক শক্তির দিক দিয়ে এই বিশাল অঞ্চল পিছিয়ে থাকবে না। রাশিয়ার হাতে রয়েছে যেমন আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি তেমনি রয়েছে জ্বালানি সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। এপাশে ইরান, ইরাক, কাতার ও সিরিয়ার হাতেও রয়েছে জ্বালানির বিশাল মজুদ। ওদিকে, চীনের হাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং আধুনিক প্রযুক্তি। ইরানও প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেক এগিয়েছে; তুরস্ক এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগামী। সব মিলিয়ে এই বিশাল অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, হত্যা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা কার্যকর জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে যা সময়ের দাবি বলেও মনে করি। সে দাবি পূরণে চীন-রাশিয়াকে আস্থায় নিয়ে ইরান ও তুরস্ক রাখতে পারে ফলপ্রসূ ভূমিকা। এ ধরনের জোট গড়ে উঠলে তুরস্কের প্রয়োজনই হবে না ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ঝোঁকার। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট থেকে সম্ভবত তুরস্ক বের হয়ে আসবে। মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে ইসরাইল ও আমেরিকার যে কুটিল ষড়যন্ত্র রয়েছে তাও বানচাল করা আরো সহজ হবে। তখন সহজেই গড়ে উঠতে পারবে নতুন চেহারার কাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের সব বড় বড় অর্থনীতি ও সামরিক জোট হিমশিম খাবে সম্ভাব্য এই জোটের মোকাবেলায়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রেডিও তেহরান।